হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 12

হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 12

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর দানের প্রতিফল

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর স্ত্রী হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর নিকট থেকে এত বড় এক বিরাট দান লাভ করে যে একেবারে নির্বিকার থাকলেন, তা নহে।
গেল। যে বিরাট দানের দৃশ্য দেখে মক্কার কোরাইশ কুল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যে অভূতপূর্ব দানের ঘটনা শুনে সারা মুসলিম জাহান স্তম্ভিত হয়ে গেল। যা- বিশ্বের ইতিহাসে চিরদিনের জন্য উজ্জল হয়ে থাকবে ।

সে দান লাভ করে যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শুধু আন্তরিক খুশি হলেন এবং প্রিয়তমা স্ত্রীকে ধন্যবাদই দিতে লাগলেন তা নহে ।
তিনি হযরত খাদীজা (রাঃ) -এর এ মহাদানের কি প্রতিদান দিতে পারেন, সে ভাবনাই শুধু করতে লাগলেন। 

তাঁর মনে শুধু এ কথা তোলপাড় করে উঠতে লাগল যে, ত্যাগ স্বীকারকারী হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁকে দ্বিধাহীন চিত্তে যে দানের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন, একটি কপর্দক বা কানা-কড়ি পর্যন্ত হাতে রাখে নাই, এ দানের সমতুল্য হতে পারে এমন কি প্রতিদান তিনি হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে দিতে পারেন ।

এই চিন্তা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে খুবই ব্যাকুল করে তুলল । তিনি হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর এ দানের বিপুল অর্থ থেকে একটি কপর্দকও তাঁর নিজের বা পরিবারের কোন কাজে ব্যয় করলেন না। তিনি উহা শুধু আরবের নিঃস্ব, দরিদ্র, অসহায় ইয়াতিমগণের সাহায্যে ব্যয় করতে লাগলেন ।
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর এ অর্থ দিয়ে সূচনাকালীন ইসলামও নানাভাবে উপকৃত হয়েছে ।

এটা সত্ত্বেও হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ভাবনা এবং অস্বস্তির অন্ত ছিল না। এই কারণে যে, উল্লিখিত দান ও সাহায্য করার সুযোগ তো তিনি হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর দান গ্রহণের মধ্য দিয়েই লাভ করেছিলেন।
কিন্তু এ সুযোগ লাভের প্রতিদান হিসেবে তো নিশ্চয়ই হযরত খাদীজা (রাঃ)-এরও কিছু পাওনা আছে। তাঁরও তো লাভ হওয়া দরকার ।

এ ধরণের ভাবনা-চিন্তা ও অস্বস্তির মধ্যেই একদিন তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তরফ থেকে নবুয়ত প্রাপ্ত হলেন। তার কিছুদিন পরেই একদা ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) এসে তাঁকে সালাম দিয়ে বললেন,
ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! মহাপ্রভু আল্লাহ তায়ালা আপনাকে সালাম জানায়ে আমার কাছে একটি খবর পাঠাইয়েছেন তা হল হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর দানের ব্যাপার সম্পর্কে আপনার কিছু ভাবতে হবে না ।

কেননা তাঁর সে দানের বিনিময় প্রদানের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা হতে গ্রহণ করেছেন ।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, এ ঘটনার কিছু দিন পরে হযরত রাসূলে (সাঃ)-এর মেরাজ সফরকালে যখন তিনি বেহেশতের মধ্যে প্রবেশ করলেন,

করীম তখন দেখলেন যে, বেহেশতের এক বিরাট কক্ষে অপূর্ব কারুকার্যময় সুউচ্চ এমন এক বিরাট প্রাসাদ অবস্থিত তেমন সুরম্য অট্টালিকা কারও ভাগ্যে কোন দিনই দর্শন লাভ ঘটে নাই
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উহার অনুপম সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হলেন এবং ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে ভাই জিব্রাঈল! এ অপূর্ব সুন্দর দালানটি কার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে?

ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) জবাব দিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! এ অনুপম প্রাসাদটি আপনার প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। পরকালে তিনিই এখানে বসবাস করবেন।
ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ)-এর কথা শুনে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) আনন্দে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ভাই জিব্রাঈল! তবে তো খাদীজা (রাঃ)-এর ধন-সম্পদ দানের বিনিময়ে উপযুক্ত প্রতিদানের ব্যবস্থাই করা হয়েছে?

ইসলামের পূর্বাভাস এবং হযরত খাদীজা (রাঃ)

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বয়স তখনও চল্লিশ বছর পূর্ণ হয় নাই। তখনও তিনি নবুয়ত লাভ করেন নাই।
তাঁর বয়স তখন অবশ্য চল্লিশের কোঠায় পদার্পণ করেছে। নবুয়ত লাভের আর কয়েক মাস মাত্র বাকি
কিন্তু এ সময় থেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নানারূপ বিচিত্র ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। এ সময় তিনি রাত্রে যে সকল স্বপ্ন দেখতেন, সেগুলি প্রায়ই পুরাপুরি ঠিক হত।

এ সময় তিনি জনপদ থেকে দূরে পাহাড়-পবর্ত বা অরণ্য এলাকায় যখন একাকী চলতে থাকতেন, তখন তিনি হঠাৎ এরূপ আওয়াজ শুনতে পেতেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আসসালামু আলাইকা (অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আপনার প্রতি শান্তি অবতীর্ণ হোক।)
সহসা এরূপ অদৃশ্য আওয়াজ শুনে তিনি চমকিয়ে উঠতেন এবং ভীতবিহ্বল চিত্তে চারদিকে তাকাতে থাকতেন।

কিন্তু কোন দিকে কিছু না দেখে আরও বেশি ভয় অনুভব করতেন। গৃহে প্রত্যাবর্তন করে তিনি এ সকল ঘটনা প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদীজা (রাঃ) এর কাছে বিবৃত করতেন। এ সমস্ত ভীতিব্যঞ্জক ও বিস্ময়কর ঘটনা শ্রবণ করে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর রমনী-হৃদয় কিন্তু এতটুকু মাত্র বিচলিত বা কম্পিত হত না।
তিনি পরম শান্ত এবং ধীর স্থির ভাবে তা শ্রবণ করতেন। 

তার এরূপ সাহসিকতা ও নির্ভিকতার কতগুলো বাস্তব কারণ ছিল। একে তো তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, তা ছাড়া জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পরিস্থিতিতে নানাবিধ সমস্যা এবং ঘটনা প্রবাহে তাঁর হৃদয়ে সঞ্চয়ের সুযোগ ও পরিবেশ এসেছিল।
তদুপরি তাঁর স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে তাঁর একটা পরিষ্কার ধারণা জন্মেছিল যে, ইনি কোন সাধারণ পর্যায়ের লোক নন।

সুতরাং তাঁর সহধর্মিণী হওয়ার মত মনোবল এবং বিশেষ ক্ষেত্রে সাহসিকতা প্রদর্শনের যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছিলেন এবং তা প্রদর্শনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। একারণেই তিনি স্বামীর মুখে ঐ সমস্ত বিবরণ শুনে বিস্মিত বা ভীতবিহ্বল না হয়ে বরং পুলকিত ও উৎসাহিত হয়ে উঠতেন এবং ভীতি-বিহব্বল স্বামীর মনে প্রবোধ ও সান্তনা দিয়ে সাহসের সঞ্চার করতেন।

হযরত খাদীজা (রাঃ) হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাধ্যমে স্বামীর যে নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন এবং সে সুযোগে তিনি তাঁকে সর্বাপেক্ষা উত্তমরূপে চিনতে পেরেছিলেন। তাঁর ভিতর-বাহির দুটি দিকই তার নিকট অত্যন্ত নিখুঁতরূপে প্রকাশ পেয়েছিল।
সুতরাং তিনি দ্বিধাহীনভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, যার চরিত্র এমন মহৎ ও নিষ্কলঙ্ক যার জীবনে কোনদিন কোন অন্যায় বা ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যায় নাই । 

যাঁর জীবন অতি পবিত্র, কস্মিনকালে অপবিত্রতার লেশও যাঁকে স্পর্শ করতে পারে নাই। তাঁর প্রতি কোনরূপ বিপদ আসতে পারে না, তাঁর কোন প্রকারেই অকল্যাণ বা অমঙ্গল ঘটতে পারে না ।
কাজেই হযরত খাদীজা (রাঃ) হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি আগত ভীতিসঙ্কুল ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেও তিনি সেগুলিকে কোনরূপ অমঙ্গলকর বা বিপজ্জনক ঘটনা মনে না করে বরং তাঁর জন্য পরম কল্যাণকর পরিণতিরই নিদর্শন বলে ভাবতে এতটুকু মাত্র সন্দেহ করতেন না।

নবুয়ত একেবারে সমাগত হবার কিছুদিন আগে ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকটে ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করলেন।
কিন্তু এ সময় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জিব্রাঈল (আ) সম্পর্কে তেমন স্পষ্ট ধারণাও করতে পারেন নাই। হেরা গুহায় তাঁর যাতায়াত এবং তথায় গিয়ে ধ্যাননিবিষ্ট হওয়া তাঁর একইভাবে চলছিল।

একদিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হেরা গুহায় অবস্থানের সময় ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) তাঁর নিকট আগমন করে তাঁকে বললেন ইকরা' অর্থাৎ হে মুহাম্মদ (সাঃ)! আপনি পড়ুন ।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আমি তো পড়তে জানিনা। তখন জিব্রাঈল (আ) তাঁর বক্ষ নিজের বক্ষের সাথে চাপ দিলেন। তারপর আবার
বললেন, আপনি পড়ুন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবারও বললেন, আমি পড়তে জানিনা ।

তখন জিব্রাঈল (আ) আবার তাঁর বক্ষের সাথে নিজের বক্ষ একটু জোরে চাপ দিয়ে তারপর আবার বললেন,
হে মুহাম্মদ (সাঃ)! “ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজী বালাক্বা, বালাকাল ইনসানা মিন আলাক ।
অর্থাৎ হে মুহাম্মদ (সাঃ) আপনি পড়ুন। আপনার সে প্রতিপালকের নামে, যিনি এক টুকরা মাংসপিন্ড থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন।

এ কালামসমূহ পাঠ করায়ে ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) চলে গেলেন কিন্তু এ অভূতপূর্ব ঘটনার প্রভাবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ভয়ে থর থর করে কাপতে লাগলেন এবং কম্পিত অবস্থায় কোন রকমে গৃহে পৌঁছে সহধর্মিনী হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে বললেন,
খাদীজা !

তুমি শীঘ্র আমাকে একটি কম্বল দিয়ে আবৃত করে দাও। এ কথা বলে তিনি শয্যায় শুয়ে পড়লেন।
হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর শরীর একটি কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়ে তাঁর শিয়রে বসে রহিলেন।

এভাবে কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর রাসূলাল্লাহ (সাঃ) একটু সুস্থ হয়ে সকল ঘটনা হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর কাছে বর্ণনা করলেন।
তারপর বললেন, খাদীজা। আমি বড় ভয় পাচ্ছি। শুনে হযরত খাদীজা (রাঃ) বললেন, প্রিয়তম! আপনার ভয়ের কোন কারণ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ পাক আপনার কোন ক্ষতি করবেন না।

কেননা আপনি তো কখনও কোন অন্যায় করেন নাই। আপনি সদা সত্য কথা বলেন, মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করেন। গরীব-দুঃখীর অভাব মোচনে চেষ্টিত থাকেন।
আত্মীয়-স্বজনদেরকে আপ্যায়ন করান। উপার্জনে অক্ষম লোকদেরকে সাহায্য করেন। বিপদাপন্ন লোকদের বিপদ দূরীকরণের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন। 

অসহায় ইয়াতীমদের মাথায় হাত বুলান। মানুষের সাথে সহৃদয়তা প্রদর্শন করেন।
অতএব আল্লাহ আপনার ক্ষতি করবেন কেন?
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর এ ধরণের সান্তনা ও প্রবোধ বাক্যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সত্যিই আশ্বস্ত হলেন এবং তাঁর মনে শান্তি ফিরে এল ।

আর একটি ঘটনা ঘটল। ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হওয়া মাত্র হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) বললেন! খাদীজা । এ যে তিনি এসেছে।
এ সময়ে ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) আগমণ করলে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শুধু একাই তাঁকে দেখলেন।

অন্য কেহই তাঁকে দেখতে পেল না।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথা শুনে হযরত খাদীজা (রাঃ) বললেন, প্রিয় স্বামী ! আপনি নিশ্চিত থাকুন ।
নিঃসন্দেহে তিনি আল্লাহর ফেরেশতা, কিছুতেই শয়তান নহে।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর হেরা গুহায় অবস্থানের মাত্রা ক্রমশঃ এত বৃদ্ধি পেল যে, তিনি মাঝে মধ্যে একাধারে কয়েক দিন পর্যন্তই সেখানে অবস্থান
করতেন।

গৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন না। একদিন তিনি ঐ গুহায় ধ্যানমগ্ন আছেন। এমন সময় ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) এসে উপস্থিত হলেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন, হে মুহাম্মদ (সাঃ)। হযরত খাদীজা (রাঃ) আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছেন। তিনি আমার পরে মহাপ্রভু আল্লাহর তরফ থেকে এবং আমার তরফ থেকে তাকে সালাম দিবেন ও তাকে এ সুসংবাদটি দিবেন যে, তার জন্য বেহেশতের মধ্যে একটি সুরম্য বিরাট অট্টালিকা সাজান হয়েছে।

অন্য একদিনের ঘটনা, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হেরা গুহা থেকে বের হয়ে গৃহাভিমুখে চলছেন, সহসা উর্দ্ধাকাশ থেকে গুরু গম্ভীর স্বরে একটি আওয়াজ হল ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ) ।
তিনি উক্ত আওয়াজ শুনে উর্ধ্বাকাশ পানে চক্ষু তুলে চেয়ে দেখলেন, এক বিরাটাকায় মূর্তি দাঁড়ায়ে আছে।
তাঁর পদতল আকাশের পূর্ব সীমান্তে এবং মস্তকদেশ মধ্য আকাশে অবস্থিত। মনুষ্য মূর্তি আবার গম্ভীর আওয়াজে বললেন, হে মুহাম্মদ (সাঃ)! 

আমি আল্লাহর ফেরেশতা জিব্রাঈল। আল্লাহর বাণী নবীদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়াই আমার কাজ। আপনিও আল্লাহর রাসূলুল্লাহ, অতএব আপনার নিকট আমি আল্লাহর বাণী পৌঁছায়ে দিতে আগমণ করব। আপনার কোনরূপ ভয় পাবার কারণ নাই।
জিব্রাঈল (আ) এভাবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও জিব্রাঈলের বিরাট মূর্তি দেখে এবং তার কন্ঠস্বর শুনে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আতঙ্ক দূর হল না।

তিনি অপলক নেত্রে স্থির দৃষ্টিতে উর্দ্ধদিকেই তাকিয়ে রহিলেন। মনে হচ্ছিল যেন , তিনি বাহ্যিক অনুভূতিই হারিয়ে ফেলেছেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং
ঐ সময় আমি উর্দ্ধাভিমুখে যেদিকে তাকাই, সে দিকেই আমার চোখের সম্মুখে শুধু জিব্রাঈলের চেহারা ভেসে উঠতে লাগল ।

ঐ সময় রানুলুল্লাহ (সাঃ)-এর অচৈতন্য অবস্থায়ই অনেক সময় কেটে গেল। পার্থিব কোন দিকেই তাঁর খেয়াল ছিল না। এ ভাবে অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন না ।

তখন হযরত খাদীজা (রাঃ) উদ্ভিগ্ন হয়ে পড়লেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অন্বেষণে লোক পাঠিয়ে দিলেন।
প্রেরিত লোক হেরা পর্বতের নির্দিষ্ট গুহায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তালাশ করল, তারপর পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল।

কিন্তু কোনখানে তাঁর সন্ধান না পেয়ে অবশেষে ব্যর্থ হয়ে ফিরে হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে খবর দিল যে, কোথাও তাঁকে পাওয়া গেল না ।
এখবর শুনে হযরত খাদীজা (রাঃ) উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কায় অধির হয়ে পড়লেন এবং তিনি নিজেই এবার তাঁর তালাশে বের হবার উদ্যোগ নিলেন
কিন্তু তার আর দরকার হল না। ঠিক এ মুহূর্তে রাসূলূল্লাহ (সাঃ) তাশরীফ আনলেন। এ সময় তিনি কিছুটা প্রকৃতিস্থ হলেও তাঁর অবস্থা সম্পূর্ণ সুস্থির হয় নাই ।

তাই এবারও তিনি পূর্বের মত হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে বললেন, খাদীজা। তুমি আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।
খাদীজা (রাঃ) তাঁর আদেশ পালন করলেন। কিছুক্ষণ এ ভাবে অতিবাহিত হবার পর রাসূলূল্লাহ (সাঃ) একটু সুস্থ হলেন।
তখন তিনি খাদীজা (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে পূর্বানুরূপ বললেন, খাদীজা। আমার অত্যন্ত ভয় হয় । আমি হেরা গুহা থেকে বের হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পথে এরূপ ঘটনা ঘটেছে।

ঘটনা শুনে হযরত খাদীজা (রাঃ) পূর্বের মতই স্বামীকে নানাভাবে সান্ত্বনা ও প্রবোধ দান করলেন। অতঃপর হযরত খাদীজা (রাঃ) অবিলম্বে স্বীয় পিতৃব্য পুত্র ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের নিকট চলে গেলেন।

ইনি খৃস্টধর্মের একজন বিশিষ্ট ধর্মযাজক এবং যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল।
এ ব্যক্তির নিকটে হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর স্বামী সংক্রান্ত ঘটনাবলির আদ্যপান্ত ব্যক্ত করলেন।

ঘটনা শুনে ওয়ারাকা ইবনে নওফেল সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, খাদীজা! তোমার বর্ণিত এ ঘটনা যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে তোমার স্বামী অবশ্যই
পয়গাম্বর ।
আমি মহাপ্রভুর শপথ করে বলছি, হযরত মূসার নিকট এ নামুসে আকবর (বড় ফেরেশ্তা) আগমন করতেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকটেও তিনিই
এসেছেন।

হযরত খাদীজা (রাঃ) ওয়ারাকার নিকট যা শুনলেন, ফিরে এসে তা সবই স্বামী রাসূলূল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে ব্যক্ত করলেন।
ঐ দিন রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এতই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন যার ফলে তিনি বহুদিনকার অভ্যাস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেলেন ।

তা হল, তিনি কখনও মক্কার বাহিরে গমন করলে প্রত্যাবর্তনের পর প্রথমেই খানায়ে কাবা তাওয়াফ করে তারপর গৃহে ফিরতেন।
ঐ অভ্যাস অনুয়ায়ী হেরা গুহা থেকে ফিরে এসে প্রতিবারই প্রথমে বানায়ে কা'বা তাওয়াফ করে গৃহে ফিরতেন ৷

ঐদিন তাঁর সে তাওয়াফ বাকী রহিল । প্রকৃতিস্থ হওয়ার পর গৃহ থেকে বের হয়ে কাবা গৃহ তাওয়াফ করতে গেলেন ।
তাওয়াফ কার্য সমাধা করে যখন তিনি গৃহে ফিরার উপক্রম করলেন, ঠিক সে মুহুর্তে কাবার প্রাঙ্গণে তাঁর ওয়ারাকা ইবনে নওফলের সাথে দেখা হয়ে গেল। রাসূলূল্লাহ (সাঃ)-কে দেখেই ওয়ারাকা বললেন, আপনার সম্পর্কে কিছু ঘটনা আমি খাদীজা (রাঃ)-এর কাছে শুনলাম, উহা আপনি নিজের মুখেই বর্ণনা করুন, আমি শুনি ।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর নিকট সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন। তা শ্রবণ করে তিনি হর্ষোৎফুল্লভাবে বলে উঠলেন,
আল্লাহর শপথ, হে মুহাম্মদ (সাঃ)! আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর নবী! আপনার কাছে সে নামুষে আকবার আগমন করেছেন ।

যিনি হযরত মূসা (আ)-এর নিকট আগমণ করতেন। আমি কসম করে লতে পারি যে, নিশ্চয়ই আপনার দেশের লোকেরা আপনাকে অবিশ্বাস করবে, আপনার প্রতি কঠিন অত্যাচার করবে, আপনাকে জন্মভূমি থেকে তাড়িয়ে দিবে এবং আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হবে।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাকে তারা দেশ ত্যাগে বাধ্য করবে?
ওয়ারাকা বললেন, নিশ্চয়ই। এতে কি আপনি আশ্চার্য বোধ করছেন? দুনিয়াতে যত নবী-রাসূল এসেছেন, সকলেরই এরূপ অসহ্য অত্যাচার ও নিপীড়ন
সহ্য করতে হয়েছে।

আপনাকেও তেমনই অপমান ও নির্যাতন সহ্য করতে হবে। যদি আমি সেদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি তবে ওয়াদা করছি, আমি আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য
করব। এ কথা বলে ওয়ারাকা ইবনে নওফেল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দিকে অগ্রসর হয়ে পরম শ্রদ্ধার সাথে তাঁর মস্তক চুম্বন করলেন।

কিন্তু আল্লাহ পাকের মর্জি ছিল অন্যরূপ। আরবের এ মহাজ্ঞানী, গুণী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে যদিও বা পূর্বাহ্নে চিনতে পেরেছিলেন কিন্তু তিনি আর বেশিদিন এ পৃথিবীতে বসবাস করতে পারলেন না। কয়েকদিন পরেই তিনি পরপারে চলে গেলেন ।