হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 13

হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 13

বিশ্বনবী (সাঃ)-এর নবুয়ত লাভ

পৃথিবীর কোন ধন-দৌলত, সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ, লোভ-লাসসা প্রভৃতি কোন কিছুই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রাণে শান্তির বারি সিঞ্চন করতে পারল না- কোন কিছুই তাঁকে সংসারে বাঁধিয়া রাখতে পারল না । তাঁর মনে সর্বদা শুধু একই চিন্তা- সেই চিন্তাই তাঁকে পাগল করে তুলল । 

খাদীজা (রাঃ) তাঁর যাবতীয় ধন-দৌলত ঢেলে দিয়েছেন স্বামীর চারণে, কিন্তু তথাপি তনি মনে একটুকুও শান্তি পান না। সর্বদা কি যেন ভাবেন তিনি
আর্ত পীড়িতের সেবা করা, শোকার্তকে সান্ত্বনা প্রদান করা, বিপন্ন ও অসহায়কে আশ্রয় দেয়া- সাহায্য করা। এগুলোই হল তাঁর নিত্য নৈমিত্তিক কাজ, এ সকল কাজ হতে একটু অবস পেলেই তিনি চলে যেতেন হেরা পর্বতের নির্জন গুহায়। সেখানে বসে আবার ধ্যানে নিমগ্ন হন তিনি।

দুই চারখানা রুটি, কিছু খেজুর ও কিছু পানি েিনয়ে কয়েক দিনের জন্য তিনি চলে যান হেরা পর্বতের নির্জন গুহায়উহা ফুরিয়ে গেলে বাড়ি এসে আবারও কিছু রুটি খেজুর ও পানি নিয়ে যান- আরও কয়েক দিন তাকেন তিনি সেখানে।

মাঝে মাঝে মহানবী (সাঃ)-এর আসতে বিলম্ব দেখলে খাদীজা (রাঃ) খাদ্য ও পানি নিয়ে যেয়ে স্বামীকে দিয়ে আসেন, কিন্তু কোন প্রশ্ন করেন না এ বিষয়ে, কখনো কোন কৈফিয়ত তলব করেন না তিনি স্বামীর নিকটে কেন তিনি এভাবে দিবারাতি হেরা পর্বতের গুহায় বসে থাকেন।
কোন কাজ কর্ম নাই, আহার নিদ্রা নাই- কি করেন তিনি এ হেরা পর্বতের গুহায় বসে?

খাদীজা (রাঃ) সহধর্মিনী ছিলেন বলিয়েই তাঁর অন্তরের ও বাহিরের প্রত্যেকটি গুণ তিনি উত্তমরূপে অবগত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তিনি সন্দেহাতীতরূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এমন নির্দোষ, নিষ্কলঙ্ক ও উন্নত চরিত্রের মহাপুরুষ রূপে।
একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হেরাগুহায় গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন একাদিক্রমে কয়েকদিন তিনি গৃহে প্রত্যাগমন না করায় খাদীজা (রাঃ) অনুমান করলেন যে, তার স্বামীর খাদ্য ও পানীয় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে এবং খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে হয়তো তিনি কষ্ট পাচ্ছেন।

এজন্য তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য কিছু রুটি ও পানি নিয়ে নিজেই হেরাগুহার দিকে আসতেছিলেন।
এমন সময় হযরত বিব্রাঈল ফেরেশতা হেরাগুহায় আগমন করে মহানবী (সাঃ)-কে বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সাঃ)! বিবি খাদীজা (রাঃ) আপনার জন্য খাদ্য ও পানীয় নিয়ে আগমন করতেছেন।

তিনি আগমন করলে আল্লাহর তরফ হতে এবং আমার তরফ হতে তাঁকে সালাম জানাবেন এবং তাঁকে সুসংবাদ প্রদান করবেন যে,
বেহেশতের ভিতরে তাঁর বিশ্বাসের পুরস্কারস্বরূপ তাঁর জন্য ইয়াতুত” লিখিত একটি সুরম্য প্রাসাদ সু-সজ্জিত করে রাখা হয়েছে।
মহানবী (সাঃ)-এর বয়স যখন চল্লিশ বছর উত্তীর্ণ হল, তখন প্রত্যহই বিব্রাঈল (আ) মানুষের বেশে এসে দূরে দাঁড়িয়ে তাঁকে “ইয়া মুহাম্মদ" বলে
সম্বোধন করতে থাকেন।

তিনি সেই সম্বোধনে কোন সাড়া না দিয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করতে থাকেন। খাদীজা (রাঃ) তাঁকে সান্ত্বনা প্রদান করেন যে, ভয়ের কোন কারণ নেই
সাহস সঞ্চলা করুন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুনরায় কিছু খাদ্য ও পানীয় নিয়ে হেরাগুহায় গমন পূর্বক পুনরায় ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। দুদিন হেরাগুহায় অবস্থান করার পর তিনি যেই মাত্র গুহা হতে বের হয়ে বাড়ির দিকে রওনা হচ্ছেন।

এমন সময় জিব্রাঈল (আ) তাঁর সম্মুখে উপস্থি হয়ে তাঁকে বলৱেন- হে মুহাম্মাদ (সাঃ)! আপনি পড়ুন-
তিনি উত্তর করলেন- আমি তো পড়তে জানি না ।
জিব্রাঈল ফেরেশতা পুনরায় বললেন- পড়ুন!
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দ্বিতীয় বারেও উত্তর করলেন- আমি তো পড়তে জানি না। 

জিব্রাঈল ফেরেশ্তা সেই কথার উত্তর না দিয়ে বললেন- আপনি বলুন- “ইকরা বিছমি রাবিকাল্লাযী খালাক্কা, খালাক্কাল ইনছানা মিল আলাক, ইকারা ওয়া রাব্বুকাল আকরামুল্লাযী আল্লামা বিল কালাম, আল্লামাল ইনছানা মালাম ইয়ালাম।”
অর্থাৎ, ইন স্বীয় রবের নামের সহিত পাঠ করুন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট বাধা রক্তের পিণ্ড হতে।

আপনি পাঠ করুন। আর আপনার রব অত্যন্ত দানশীল, যিনি মানুষকে কলমের সাহায্যে শিক্ষাদান করেছেন- যা মানুষ জানত না তাও তিনি শিক্ষা দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ভয়ে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে জিব্রাঈন পেৱেশতাৱ সাথে সাথে উক্ত কালামগুলো পাঠ করলেন।
জিব্রাঈল ফেরেশ্তা তাঁকে সেই দিনকার মত এই পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান করেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন ।

ইহাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি সর্ব প্রথম আল্লাহ্র তরফ হতে ওহী নাযিল এবং এই দিনই তাঁর নবুয়ত লাভের প্রথম দিন ।
নবুয়তের প্রথম দিনে জিব্রাঈল ফেরেস্তা আল-কোরআনের কিয়দাংশ শিক্ষা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবার পরই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ভয়ে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি পৌঁছলেন ।

বাড়ীর সদর দরজা তখন ভিতর হতে বন্ধ করা ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) জোরে বাবার দরজায় করাঘাত করতে লাগলেন । খাদীজা (রাঃ) তাহার চোখ মুখের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কি?
রাসূলুল্লাহ (রাঃ) কম্পিত কণ্ঠে ভীতস্বরে বললেন- খাদীজা। আমাকে আবৃত কর- আমাকে আবৃত কর, আমার বড় ভয় হচ্ছে।

খাদীজা (রাঃ) তাড়াতারিড় স্বামীকে শয়ন করাইয়া একখানা কম্বরের দ্বারা তাঁর সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া দিলেন।
কোন কোন কেতাবে উক্ত ঘটনার বর্ণনা নিম্নরূপ দেখা যায়- নবুয়তের প্রথম দিনে মহা পবিত্র কুরআনের কিয়দাংশ শিক্ষা দিয়ে জিব্রাঈল ফেরেশতা অদৃশ হয়ে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন।

কিন্তু কিছুদূর গমন করবার পরই তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন এদিকে খাদীজা (রাঃ) স্বামীকে দুদিন যাবত না আসতে দেখে তিনি কিছু বাদ্য ও পানীয়সহ তাঁর দুইজন বিশ্বস্ত অনুসারীকে হেরা গুহার পাঠায়ে দিলেন উক্ত অনুসারীদ্বয় দেখতে পেল যে, হেরা গুহার কিছু দূরে মাঠের মধ্যে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, অনুসারীদ্বয় তাঁকে সংজ্ঞাশূন্য অবস্থায় ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে গেল।

বাড়ি পৌছবার পর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জ্ঞান সামান্য একটু ফিরে আসল, তখন তিনি খাদীজাকে বললেন- খাদীজা। আমাকে আবৃত কর, আমাকে আবৃত কর- আমার বড়ই ভয় হচ্ছে। খাদীজা (রাঃ) স্বামীকে শয়ন করিয়ে দিয়ে একখানা কম্বল দ্বারা তাঁর সর্বাঙ্গ ঢেকে দিলেন।
খাদীজার সান্ত্বনা বাক্যে ও অভয় প্রদানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মনে আবার অনেকটা সাহসের সঞ্চার হল। 

তিনি খাদীজাকে সে দিনকার সব ঘটনাই খুলে
জিব্রাঈল (আ) তাঁকে কুরআন শরীফের যে কয়টি আয়াত পাঠ করিয়েছিলেন তা তখনও তাঁর সুস্পষ্ট মনে ছিল, তিনি খাদীজাকে তা পাঠ করিয়ে
উহা প্রবণ করে কাদীজা (রাঃ) অত্যন্ত আনন্দিতা হইয়ে বললেন- আপনার ভয়ের কোন কারণ নাই- তৌরাত ও ইঞ্জিল কেভাবে এরূপ অনেক ঘটনা উল্লেখ
আছে ।

আপনি যদি অনুমতি প্রদান করেন, তবে আমি ওরাকা বিন নওফেলের নিকট যেতে এই সম্বন্ধে তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি। তিনি তৌরাত ও ইঞ্জিল কেতাবে বিশেষ অভিজ্ঞ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তিনি এই সম্বন্ধে সব কথাই বলতে পারবেন। রাসূলে পাক (সাঃ) খাদীজার প্রস্তাবে সম্মত হলেন।
পরদিন সকালে তিনি মহানবী (সাঃ)-সে সাথে নিয়েই ওরাকা বিন নওফেলের নিকট গমন করে পূর্বের ঘটনার বর্ননা করলেন।

হযরত খাদীজার অনুরোধে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওরাকার নিকট সব কথা খুলে বললেন। এমন কি কুরআন মজীদের আয়াত কয়টিও পাঠ করে শুনালেন ।
এসব কথা শুনে ওরাকা বিন নওফেল বললেন - আপনার বর্ণনা শুনে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে যে, হযরত মূসা ও ঈসা (আ) সহ প্রভৃতি নবীদের নিকট যিনি আগমন করতেন, তিনিই আপনার নিকট এসেছিলেন- তাঁর নাম জিব্রাঈল ফেরেশতা।

বর্তমান যুগে যে একজন নূতন ধর্ম প্রচারকের আবির্ভাবের কথা কেতাবে বর্ণিত আছে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে যে,
আপনিই সেই নূতন ধর্ম প্রচারক শেষ নবী হইবেন । নবী ব্যতীত অন্য কোন লোরেক নিকট জিব্রাঈল ফেরেশতা আগমন করেন না।
আর একদিন জিব্রাঈল (আ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সাথে নিয়ে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে ঘুরিয়ে আনতে পুনরায় হেরা গুহার নিকট পৌঁছায়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

সেই সময় জিব্রাঈল ফেরেশ্তার গলায় একখান ছোট পাথর ঝুলানো ছিল। একদা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নিজ গৃহে বসে খাদীজার সাথে কথাবার্তা বলতেছিলেন, ঠিক এমন সময় সেখানে জিব্রাঈল ফেরেশতা এসে উপস্থিত
হলেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খাদীজাকে বললেন-“ঐ দেখ, তিনি এসেছেন।”
খাদীজা (রাঃ) কাহাকেও দেখতে না পেয়ে বলরেন- কৈ, আমি তো কাহাকেও দেখতে পাচ্ছি না ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন- “ঐ তো, তিনি আমাদের বাড়ির সদর দরজার নিকট দাঁড়িয়ে রয়েছেন।”

খাদীজা (রাঃ) যদিও দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করেছিলেন যে, বিশ্বননীর নিকট আগমনকারী স্বর্গীয় দূত জিব্রাঈল (আ) ব্যতীত অন্য কেহই নহেন, তথাপি সময় সময় তিনি স্বামীর ভবিষ্যৎ বিপদের আশঙ্কা করে নানারূপ সন্দেহের ঘুর্ণিপাকে পড়ে যাতেন । সেজন্য তিনি আগন্তুককে আরও একটু ভালরূপে পরীক্ষা করে দেখতে মনস্থ করলেন ।

পূর্বোক্ত ঘটনাসমূহের কয়েকদিন পরে একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তাঁর হাতে তখন রেশমী রুমালে জড়ানো একখানা কেতাব ছিল । তিনি এসেই রাসূল্লাহ্ (সাঃ)-কে বললেন পড়ুন!
তিনি পূর্বে মতই উত্তর করলেন- কি পড়ব? আমি তো পড়তে জানি না
তিনি জিব্রাঈল ফেরেশতা তাঁকে স্বীয় বক্ষের সাথে এমন সজোরে চেপে ধরলেন যে, তাঁর মনে হতে লাগল- এখনই বুঝি আমার প্রাণ বের হয়ে এখানেই আমার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে।

জিব্রাঈল (আ) তাঁকে ছেড়ে দিয়ে পুনরায় বললেন- পড় ন !
তিনি আবার উত্তর করলেন- কি পড়ব, আমি তো পড়তে জানি না । জিব্রাঈল ফেরেশতা দ্বিতীয়বার তাঁকে আরও অধিক জোরে স্বীয় বক্ষের সহিত চেপে ধরলেন । তৎপর ছেড়ে দিয়ে তৃততীয়বার বললেন- পড়ুন !
তিনি এবারেও পূর্বের মতই উত্তর দিলেন- কি পড়ব? আমি তো পড়তে জানি না ।

এভাবে জিব্রাঈল ফেরেশ্তা মহাপবিত্র কুরআন মজীদে কতিপয় আয়াত পাঠ করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাথে সাথে উহা পাঠ করলেন।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আল্লাহ্র অসীম কুদরতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিব্রাঈল (আ)-এর সাথে সাথে কুরআনের আয়াতগুলো পাঠ করবার পর উহা তাঁর হৃদয় পটে অঙ্কিত হয়ে যেত- তিনি আর কখনও উহার একটি শব্দও ভুলে যেতেন না । 

অতঃপর প্রায় প্রত্যহই একবার করে জিব্রাঈল (আ) অবতীর্ণ হতে লাগলেন এবং কুরআন মজীদের কিছু কিছু অংশ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শিক্ষা দিয়ে যেতে লাগলেন । ক্রমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অন্তর হতে ভয় দূর হয়ে গেল ।