হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 2

হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 2

ধাতৃ হালিমা সাআদিয়ের ঘরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)

আরবে তখন ব্যাপকভাবে প্রচলন ছিল, ধনী অভিজাত শ্রেণীর লোকজন তাদের শিশু সন্তানদেরকে স্তন্য ও লালন-পালন করার উদ্দেশ্যে গ্রামে বসবাসকারিণী ধাত্রীদের হাতে সোপর্দ করত। ধাত্রীগণ নিজ সন্তানের মত পরম যত্নে তাদেরকে নিজের দুগ্ধ দ্বারা লালন-পালন করতেন। 

এ ব্যবস্থার ফলে উত্তম পরবেশ এবং ধাত্রীদের আন্তরিকতার সাথে যত্নের ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক দু'দিক দিয়েই উপকার এবং উন্নতি হত ।
হযরত হালিমা (রা) নিজের জন্য দুগ্ধপোষ্য শিশু সংগ্রহ ও শিশু নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর লালন-পালন সম্পর্কে নিজের মুখে যে সকল উক্তি পেশ করেছিলেন, এখানে আমরা তাই বলছি।

হযরত রাসূলে করীম (সাঃ)-যে বছর ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, সে বছর শুরুর কিছুদিন পূর্বে আরবে বিশেষত মক্কার চতুর্দিকের জনপদগুলোতে বেশি দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল । যার ফলে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সঙ্কটাপন্ন হলেও দরিদ্র লোকজন একেবারে চরম সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছিলেন। 

হালিমা বলেন : এত প্রবল অভাব দেখা দিল যে, খাদ্যাভাব ও অর্থাভাবে আমার ঘরের সকলে অনাহারে কাটাত। আমার এক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে আমার স্বামী ময়দান হতে ঘাস কেটে এনে বাজারে বিক্রয় করে অতি সামান্য যে মূল্য পেতেন তা দ্বারা কোনরূপে দু'একদিনের সামান্য খাবার যোগাড় হত। অবশ্য আমি কখনও এতে অধৈর্য হইনি। সর্বাবস্থায়ই আল্লাহতায়ালার শোকর আদায় করে ধৈর্যাবলম্বন করে রয়েছি।

ঘটনাক্রমে ঐ সময় আমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। কাজেই ঐরূপ অবস্থায় অনাহারে থাকার ফলে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। যথাসময় আমার একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হল । তার নাম রাখলাম মুনির। ক্রমাগত অনাহারে থেকে আমার স্তনের দুগ্ধ শুকিয়ে গেল । সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু সন্তানটি দুধ না পেয়ে মরণ অবস্থায় উপনীত
হল।

এমনি অবস্থায় আমি একদিন নিদ্রিতাবস্থায় স্বপ্নে দেখলাম, একটি স্বচ্ছ পানিভর্তি পুষ্করিণী আর তার পানি হতে মেশকের ঘ্রাণ নির্গত হচ্ছিল । পানির রং দেখা যাচ্ছিল অবিকল দুগ্ধের মত। জনৈক অপরিচিত ব্যক্তি আমাকে বলল, হালিমা! তুমি যত পার এ পুষ্করিণীর পানি পান করতে পার। তাতে তোমার বুকের দুধ বৃদ্ধি পাবে এবং তোমার দেহও সবল হবে। 

তার কথামত আমি পানি পান করলাম। তাতে সত্যই আমি অত্যন্ত আরাম বোধ করলাম । তখন সেব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?
আমি বললাম, চিনব কি করে? 

তোমাকে তো আর কখনও আমি দেখিনি। তখন সে বলল যে, আমি তোমার শোকর। তুমি চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়ও আল্লাহর শোকর আদায় করেছ, এজন্যই তিনি আমাকে তোমার নিকট পাঠিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা তোমার উপর অত্যন্ত খুশী। সুতরাং দেখবে আজ হতেই তিনি স্তনে দুগ্ধ বাড়িয়ে দিবেন। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। জাগ্রত হয়ে দেখলাম, দুটি স্তনই দুগ্ধে পরিপূর্ণ । 

এ আশ্চর্য ঘটনার আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে আল্লাহর দরবারে অসংখ্য শোকর আদায় করলাম।
তিনি বাড়ীতে পৌঁছে দেখতে পেলেন, তাঁর কৃশ ও দুর্বল বকরীগুলো খুবই বলিষ্ঠ ও হৃষ্ট-পুষ্ট হয়ে গেছে। প্রত্যেকটি বকরীর বাঁটই দুধে পরিপূর্ণ। এতে তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলেন। কারণ মক্কা রওয়ানা হবারকালে এগুলো একেবারে অর্ধমৃত ছিল, আর এ অল্প সময়ের ব্যবধানে এরূপ পরিবর্তন কি করে সম্ভব হল। 

হালিমার বকরীগুলো এত বেশী পরিমাণে দুধ দিতে লাগল যে, তা দেখে তাঁর প্রতিবেশীগণ আশ্চর্য হয়ে গেল। তারা বিবি হালিমার কাছে এর কারণ জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তিনি তার কোন জবাব না দিয়ে নীরব রইলেন।
উম্মুল মো'মেনীন হযরত খাদীজা (রাঃ)

তৎকালীন আরব সমাজ

যে মহিয়ষী মহিলা, সর্ব প্রথম বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আল্লাহ্ নবী বলিয়া বিশ্বাস করিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া দুনিয়ায় অমর কীর্তি স্থাপন করে গিয়েছেন, সেই মহাপুণ্যবতী ও চিরস্মরণীয়া মহিলা নাম হযরত খাদীজা তাহিরা (রাঃ)।

ইসলামের ইতিহাসে হযরত খাদীজা (রাঃ) মত ব্যক্তিত্ব সম্পন্না রমণী আর কেহই নাই। তিনি নিজের অতুল ঐশ্নবর্য বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইসলামের ইসরামের খিদমতের জন্য, তা ছাড়াও অশেষ দুঃখ-কষ্ট ও নাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেছিলেন তিনি বিধর্মীদের হাতে, ইসলাম গ্রহণ করার জন্য। হযরত খাদীজা (রাঃ)-র দানের কথা সমগ্র দুনয়ার মুসলমানগণ কিয়ামত পর্যন্ত অত্যন্ত শ্রদ্ধার
সাথে স্মরণ করবে।

হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে জানতে হলে, তৎকালীন আরবের পরিবেশ, প্রাকৃতিক অবস্থা অধিবাসীদের আচার-ব্যবহার, চালচলন, রীতিনীতি প্রভৃতি বিষয়ে একটা মোটামুটি ধারণা থাকা আবশ্যক। হযরত খাদীজা (রাঃ) জন্মের পূর্বে আরবের সমাজ ব্যবস্থা ছিল ভয়াবহ!

আমাদের দেমর পশ্চিমে ধূসর মুরময় আরব দেশ- সেইখানে বৃষ্টি হয় না, বন্যা হয় না, চারিদিকে শুধু কঙ্করময় ধূসর বালি আর বালি।
আমাদের দেশের মত সেখানে গাছাপালা, বনজঙ্গল ও নদী-নালা বলতে কিছুই নাই। “সুজনলা সুফলা শস্যশ্যামলা” কথাটা কেবল আমাদের দেশের জন্যই প্রযোজ্য- অন্য কোন দেশের জন্য নহে, আরবদেশের জন্য তো মোটেই নহে ।

আরবের সুবিস্তীর্ণ মরুভুমির মধ্যে আছে শুধু মাঝে মাঝে দুই চারটি করে খেজুর গাছ। খেজুর খুরমা-ই সেই দেশের লোকের প্রধান খাদ্য। দিগন্তব্যাপী ধূসর মরুভূমির মাঝে মাঝে আছে দুই একটা করে মরুদ্যান, আর সেই মরুদ্যানেই জন্মে কিছু কিছু ঘাসপাতা ও খেজুর খুরমার গাছ।

রুক্ষ্ম আবওহাওয়ার কারণে সেই দেশে জীবনযাপনে খুবই কষ্টকর। তবুও সেই দেশে মানুষ বাস করে। কারণ সেই দেশ তাদের নিজেদের দেশ।
শুধু তাই নহে- সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষও সেই দেশকে বড় ভালবাসে- ভক্তি শ্রদ্ধা করে, কারণ দেশটি বড়ই পবিত্র ।
আল্লাহ্ পবিত্র বাণী নিয়ে এই দেশেই আগমন করেছিলেন আল্লাহ্র নবী হযরত মূসা, ঈসা, ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ)।

আরও কত আম্বিয়া ও আউলিয়ার পবিত্র পদস্পর্শে যে ধন্য ও পবিত্র হয়েছে এই দেশের প্রতিটি ধুলিকণা, তার অন্ত নেই ।
আমাদের অন্তিমের কাণ্ডারী নূরবনী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পূর্ব পুরুষ হযরত ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করেন ও লালিত-পালিত হন এই দেশেই। এই দেশেই হযরত ইসমাঈল (আ) পুণ্যবতী মাতা হযরত হাজেরা নির্বাসিত হয়েছিলেন এবং তারই উপলক্ষে সুবিস্তীর্ণ ধূসর মরুভূমির বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজিকার এই পবিত্র মক্কা নগরী ।

ইযরত ঈসা (আ)-এর ইন্তেকালের পর হতে সুদীর্ঘ পাঁচশত বছরের মধ্যে আল্লাহ্র বাণী ও সত্য ধর্ম প্রচার করবার জন্য কোন নবী আসলেন না। এদিকে পাপীষ্ঠ শয়তান নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে ছিল না- কোন নবী না থাকায় সে পাপের অনুষ্ঠানে লোকদিগকে নিযুক্ত করবার ও তার প্রচার কাজ চালাবার সুযোগ পেল । কাজেই সমগ্র পাপের গহ্বরে ডুবিয়া গেল ।

শাসন, বিচারও আইন কানুন বলতে কিছুই ছিল না তখন। কে মানে কাকে- কে শুনে কার কথা? জোর যার মুল্লুক তার এই নিীতি অবলম্ব করেছিলেন সকলেই যাদের শক্তি ও দাপট ছিল, দুর্বল ও অধম লোকেরা তাদের পদতলে নিষ্পেষিত করেছিল। নারীগিগকে নিয়ে পুরুষ লোকেরা পাশবিক লীলা-খেলা চালাচ্ছিল। নারী শুধু পুরুষে ভোগের সামগ্রীরূপে বিবেচিত হয়ে আসতেছিল । 

এ ছাড়া তাদের কোন মূল্যই ছিল না পুরুষদের নিকট
আল্লাহ্র ঘর খানায়ে কা'বা বা বায়তুল্লাহ শরীফ। এই ঘর নির্মাণ করেছিলেন আল্লাহ্র পিয়ারা নবী হযরত ইব্রাহীম (আ) এবং তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ) আল্লাহ্র ইবাদত করার উদ্দেশ্যে। আরবের লোকেরা সেই পবিত্র ঘরে সাজাইয়া রাখিয়াছিল তাদের দেবতার মূর্তিগুলোকে। অর্থাৎ, তাদের নিজহাতে গড়া কতকগুলো পাথরের পুতুলকে। 

আর তাও দুই চারটি বা দশ বিশটি নহে- সর্বমোট তিনশত ষাটটি মূর্তি স্থাপন করেছিল তারা পবিত্র কা'বা ঘরে।
কন্যা সন্তানদের কোন মূল্যই ছিল না তাদের কাছে। কাহারও কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে শিশুকালেই মেরে ফেলত বা জীবন্ত করব দিত। নিজের কন্যাকে অন্যের নিকট বিবাহ দিতে হবে এই ছিল তাদের মতে অত্যন্ত অপমানজনক কাজ। 

তাছাড়া দরিদ্র হওয়ার ভয়েও অনেকেই আপনাপন কন্যা মেরে ফেলত বা শিশুকালেই জীবন্ত করব দিত ।
সেই জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা'আলা দুনিয়ার বুকে পাঠিয়ে দিলেন একটি শিশুকে-দুনিয়ার ভ্রান্ত মানবদিগকে পথ প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে। 

সে আজ অনেক দিন আগের কথা- হযরত ঈসা (আ)-এর ইন্তেকালের পাঁচশত বছর পরের কথা এবং এখন হতে পনরশত বছর আগেকার কথা। এই শিশুটিই কালক্রমে সারা দুনিয়ার শান্তির দূরত আলোর দিশারী, মানবতার প্রতীক, বিশ্বসত্যতার গোলাপ বিশ্বনবী বলে পরিচিত ।