হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 1

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 1

আল্লাহ তাআলার পরিচয়

( পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি )
এ বিশাল সাম্রাজ্য ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে অবশ্যই বুঝা যায় যে, এর সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় একজন আছেন- যিনি এসব এবং মানব ও জ্বীন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আল্লাহ । আল্লাহ তায়ালা এক ও অদ্বিতীয় তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁর কোন সন্তানাদি নেই। 

তিনি আসমান জমীন, আরশ-কুরছি, লৌহ-কলম, চন্দ্র-সূর্য, তারকা, বেহেস্ত-দোযখ, ফেরেস্তা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি সব সৃষ্টি করেছেন। 
তাঁর পানাহার, বিশ্রাম, নিদ্রা, তন্দ্রা কিছুই দরকার হয় না। 

তিনি নিরাকার ও সমগ্র জগতের মালিক। তিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মাঝে প্রায় ১৮ হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে মানব জাতিকেই আশরাফুল মাখলুকাত করে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আদম সন্তানকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহপাক বলেন-

উচ্চারণ : ওয়ালাকাদ খালাকনাল ইনছানা মিন্ ছালছালিম্‌ মিন্ হামাইম্মাছনূন । ওয়াল্ জ্বান্না খালাকনাহু মিন কাবলু মিন্ নারিচ্ছামূম ।
অর্থ : আর আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে (আদম সন্তানকে) বিশুষ্ক শব্দায়মান মাটি হতে যার প্রস্তুতি পচা কদম হতে এবং তার পূর্বে আমি জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেছিলাম 'লু' বা অগ্নি বাতাস হতে। -সূরা হিজর : আয়াত ২৬-২৭

আল্লাহ তাআলা নিজের পরিচয় প্রদান করে পবিত্র কোরআন শরীফের 'সূরায়ে এখলাছে' এরশাদ করেছেন-
হে নবী! আপনি ঘোষণা করে দিন যে, আল্লাহ এক; আল্লাহ্ কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাকেও জন্ম দেন না এবং তিনি কারও ঔরসজাত নন। আর শক্তিতে, জ্ঞানে ও গুণে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।”
সূরা ইখলাস ঃ আয়াত ১-৪

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনাদিকাল থেকেই স্বীয় অস্তিত্ব ও মহিমা সহকারে বিরাজ করছেন এবং অনন্তকাল পর্যন্ত বিরাজমান থাকবেন। সৃষ্ট জগতের পত্তন-ধ্বংস, জরা-মৃত্যু, উত্থান-পতন, সুপ্তি-বিলুপ্তি হতে তিনি চির পবিত্র। এই বিশ্বচরাচরে তাঁর কর্তৃত্ব ও মালিকানা ছাড়া অপর কাহারও কোন অধিকার নেই তিনিই সব কিছুর পরিচালক, নিয়ামক ও রক্ষাকর্তা। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কালামে পাকের ‘আয়াতুল কুরসীতে' আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন-

অর্থ : তিনিই আল্লাহ্, যিনি ব্যতীত অন্য কোনই মা'বুদ নেই। তিনি চির জীব ও চিরস্থায়ী। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শও করতে পারে না । নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু রয়েছে, তিনিই তাদের অধীশ্বর। -সূরা বাক্বারা : আয়াত ২৫৫ আল্লাহ পাক এরশাদ করেন-

অর্থ : তিনিই আল্লাহ, যিনি আকাশেও একমাত্র উপাস্য এবং জমীনেও একমাত্র উপাস্য । তিনি মহাবিজ্ঞানী ও সর্ব-বিষয়ে সুপরিজ্ঞাত ।
- সূরা যুখরূপ : আয়াত ৮৪

খাদীতুল কোবরার স্বামী ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ
(সাঃ)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) নিজ বংশ বর্ণনায় উক্ত ২১ পোতই উল্লেখ করেছেন। (ফতহুল রাবী, ৭ম খণ্ড)
আবদুল্লাহ্ বিশ বছর বয়সে পদার্পণ করিলে কুরাউশবংশীয় ওয়াহাব জোহরীর কন্যা আমেনার সহিত শুভ বিবাহ হইল । বিবি আমেনা ছিলেন- রূপেগুণে অতুলনীয়া এবং পরমা পুণ্যবতী। 

বিবাহের অল্পকাল পরেই আবদুল্লাহ বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়া গমন করলেন, তখন বিবি আমেনা গর্ভবতী ।
বাণিজ্য হইতে প্রত্যাবর্তনকালে আবদুল্লাহ কয়েকদিন বিশ্রাম করবার উদ্দেশ্যে মদীনায় অবতরণ করলেন এবং এখানেই তিনি কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ।

এইরূপে মাতৃগর্ভে থাকতেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পিতৃহীন হইলেন । আমেনার প্রসবকাল যতই নিকটবর্তী হচ্ছিল, তিনি ততই নানা প্রকার অলৌকিক ঘটনাবলী দর্শন করিয়া বিস্মিতা হচ্ছিলেন ।
প্রসবের কয়েক দিন পূর্বে আর এক রাত্রে মা আমেনা স্বপ্নে দেখলেন- ফেরেশতা তাঁর গৃহে আগমন করে তাঁকে সম্বোধন করে বলছেন- হে আমেনা ! 

আপনি অবগত আছেন কি যে, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাহমাতুলিল আলামীন আপনার গর্ভে অবস্থান করছেন । আপনি পরমা ভাগ্যবতী রমনী !
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল দিবাগত রাত্রি হযরত আমেনার প্রসব বেদনা আরম্ভ হল ।
প্রসবকালীন পরিচর্যা করবার মত স্ত্রীলোক সেদিন বিবি আমেনার গৃহে ছিল না, সেজন্য তিনি অত্যন্ত চিন্তিতা হয়ে পড়লেন! 

সহসা তিনি দেখতে পেলেন- আকাশ হতে একটি উজ্জল আলো ধরার বুকে নেমে আসল... সেই আলোকে আবার সমগ্র দুনিয়া আলোকিত হয়ে গেল ।
এবার সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় বাস্তব চোখে তিনি দেখলেন- আসমান হইতে জমিন পর্যন্ত একটা বিরাট সিঁড়ি স্থাপন হয়েছে- উক্ত সিঁড়ি বেয়ে চারজন পরমা সুন্দরী রমনী নেমে আসলেন। বিবি আমেনা তাদেরকে নিজের গৃহে প্রবেশ করতে দেখে ভীতা ও চমকিতা হলেন ।

আগন্তুকা রমনীগণ তাঁকে অভয় প্রদান করিরে বললেন- আপনার ভয়ের কোন কারণ নাই, আপনার পরিচর্যা করার জন্য আল্লাহ্ তাআলা বেহেশত হতে আমাদিগকে পাঠিয়েছেন ।
আমাদের পরিচয় যথাক্রম- হযরত ইসমাঈলের মাতা হাজেরা, ফেরআউনের স্ত্রী আছিয়া এবং ঈসা নবীর মাতা মরইয়ম। আ বেহেশতের কতিপয় হুর আমাদের সাথে আসিয়াছে।

অতঃপর সুবহেসাদেকের সময় বিশ্বের মহাকল্যাণস্বরূপ বিশ্বননী ধুলির ধরায় শুভ পদার্পণ করলেন ।
সাথে সাথে ফেরেস্তাগণ সমসুরে গেয়ে উঠল- ইয়া নবী ছালাম আলাইকা, ইয়া রাসূল ছালাম আলাইকা, ইয়া হাবীব ছালাম আলাইকা- ছালাওয়াতুল্লাহ আলাইকা ।

সে এক আশ্চর্য ব্যাপার ।

বিশ্বনবী ধরার বুকে শুভ পদার্পণ করার সাথে সাথে সমগ্র বিশ্বে কম্পন সৃষ্টি হল । কা'বা গৃহের যে তিনশত ষাটটি মূর্তি স্থাপিত ছিল তার প্রত্যেকটি সেই কম্পন সহ্য করতে না পেরে উপুড় হয়ে গেল! পারস্যের অগ্নি পূজকগণ সহস্র বছর যাবত যে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জলিত রাখিয়াছি, সহসাই উহা নির্বাপিত হয়ে
গেল ।

পারস্যের কাফের বাদশাহ নওশেরওয়ার সিংহাসন উপুড় হয়ে পড়ে গেল— এমনি আরও বহু আশ্চর্য ঘটনা সংঘটিত হল। পাঁচশত সত্তর অথবা পাঁচশত একাত্তর ঈসায়ী সনের বারই রবিউল আউয়াল মাসের রোজ সোমবার ছোবহে ছাদেকের সময় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মাতৃগর্ভ হতে এ পৃথিবীতে
শুভাগমণ করলেন ।

হযরত রাসূলে করীম (সাঃ)-এর সে জন্মনিশিতে যে সকল অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, বিশ্ব-মাননীয়া তাঁর জননী বিবি আমেনা নিজ মুখে তা বর্ণনা
করেছেন এভাবে :
হুযুরে পাক (সাঃ)-এর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বিবি আমেনা ঘরের মধ্যে সম্পূর্ণ একাকিনী ছিলেন। 

হঠাৎ তিনি আকাশের দিক হতে একটা প্রচণ্ড আওয়াজ শুনতে পেয়ে অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। পরক্ষণেই অবিকল মোরগাকৃতি একটি পাখী উড়ে এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল ও তার পালক দুটি বিবি আমেনার মাথা স্পর্শ করাল। তাতে তাঁর অন্তর হতে সমস্ত ভয়-ভীতি দূর হল এবং তিনি বেশ আনন্দ ও আরাম বোধ করতে লাগলেন। তখন মোরগটি কিছু মিষ্টি জাতীয় খাদ্য বিবি আমেনার মুখে ঢুকিয়ে দিল ।

বর্ণনান্তরে দেখা যায়, মোরগটি চলে যাবার পর জনৈক সুন্দর যুবাপুরুষ এসে বিবি আমেনাকে একগ্লাস, মিষ্টি শরবত পান করাল । তা দেখতে ছিল দুধের মত সাদা, কিন্তু খেতে ছিল মধুর মত মিষ্টি । বিবি আমেনা বলেন, এরপর আমা হতে যেন একটা অপরূপ জ্যোতি বের হয়ে উর্ধাকাশের দিকে উঠে গেল। পরক্ষণেই আমার নিকট কয়েকজন সুন্দরী স্ত্রীলোক এসে উপস্থিত হলেন। 

আমি তাঁদের পরিচয় জিজ্ঞেস করে জানলাম, তাঁরা হলেনঃ হযরত হাজেরা, হযরত মরিয়ম এবং হযরত এসে। তাঁরা আমাকে বিশেষভাবে আশ্বস্ত করলেন, আপনার কোন দুশ্চিন্তা বা ভয়ের কারণ নেই । আল্লাহর নির্দেশে আমরা আপনার পরিচর্যার জন্য আগমন করেছি। এ সময় আমি একটি অদৃশ্য আওয়াজ শুনতে পেলাম : শিশুটিকে মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে রাখুন ।

আমি তারপর আবার দেখলাম, বেশ কিছু সুন্দরী মহিলা রূপার তস্তরীতে করে মেশক, আম্বর ও অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্য নিয়ে এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল । আমি আরও দেখতে পেলাম যে, কতকগুলো অপূর্ব পাখী আমার ঘরের উপরে উড়ে বেড়াতে লাগল । ঐ ধরনের সুন্দর বর্ণ এবং আকৃতির পাখী ইতোপূর্বে আমি আর কোনদিন দেখিনি। তা দেখে আমার চক্ষু জুড়িয়ে গেল। 

এমনি অবস্থার মধ্যে আমার পুত্র মুহাম্মদ (সাঃ) ভূমিষ্ঠ হল । আমি কোনকিছুই উপলব্ধি করতে পারলাম না। সে ভুমিষ্ঠ হয়েই সিজদায় পতিত হয়ে বলল, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।'

• শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার রাতে ঘটনাক্রমে আমার ঘরে কোন প্রদীপ ছিল না। কিন্তু আমার ছেলের দেহের আলোকে আমার ঘরাভ্যন্তর এরূপ আলোকিত হল যে, ঘরের মেঝে পতিত সূঁচও সে আলোতে তুলে লওয়া যেত । 

সে আলোর ছটা এমনই উজ্জ্বল ছিল যে, তার ঝলকে সুদূরবর্তী সিরিয়া দেশটি পর্যন্ত আমার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল 1
বিবি আমেনা বলেন, এরপর একখন্ড সাদা মেঘ নেমে এসে শিশুকে আমার কোল হতে তুলে নিয়ে গেল। এ সময় কে যেন বলল, একে পূর্ব পশ্চিমের সমগ্র এলাকা ঘুরিয়ে নিয়ে আস, যেন সারাটা দুনিয়া এর নিকট পরিচিত হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর উক্ত সাদা মেঘখন্ড প্রত্যাবর্তন করে আমার পুত্রকে আবার কোলে ফিরিয়ে দিল। পরক্ষণেই দেখলাম, সূর্যালোকের মত সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট তিনজন এসে আমার নিকট দন্ডায়মান হল। তাঁদের একজনের হাতে ছিল একটি স্বর্ণের লোটা, আর একজনের হাতে ছিল এক টুকরা রেশমী কাপড়ে আবৃত আংটি এবং অন্যজনের হাতে ছিল একখন্ড সুন্দর পশমী কাপড় । 

তাদের প্রথম ব্যক্তির কোল হতে আমার ছেলেকে নিয়ে তাদের লোটার পানি দিয়ে তাঁকে গোসল করাল । দ্বিতীয় ব্যক্তি রেশমের কাপড়ের ভিতর হতে আংটিটি বের করে তার দু’স্কন্ধের মাঝখানে ঐ আংটির দ্বারা একটি চাপ মেরে দিল । অতঃপর তৃতীয় ব্যক্তি তার হাতে রাখা পশমী কাপড়ে লেপটায়ে তাকে আমার কোলে দিয়ে তাঁর কানে কানে কিছু কথা বলল। আমি তার সবকথা বুঝতে পারলাম না। 

তবে যা বুঝতে পারলাম তা এই যে, 'হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তোমাকে এমন গায়েবী এলেম দান করলেন, যা কাউকেও দেয়া হয়নি। আর তোমার প্রতি শুভ সংবাদ এই যে, যারা তোমাকে আল্লাহর নবী বলে মান্য করবে ও তোমার প্রতি ঈমান আনবে তারা তোমার উম্মত বলে গণ্য হবে এবং তারা দোযখের আযাব হতে বেঁচে যাবে।'