হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 8

হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 8

মহানবী (সাঃ)-এর সাথে খাদীজার সাক্ষাৎ

মুহাম্মদের ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই পাড়াপ্রতিবেশি এবং দুসম্পর্কের চাচাবোন হওয়ায় দেখতে আসেন। খুওয়াইলিদের কন্যা খাদীজা সংবাদ শ্রবণ করা মাত্র দৌড়াইয়া আসলেন এ নবজাত শিশুকে দেখে চুম্বনে চুম্বনে সিক্ত করে দিয়েছিলেন শিশুর কচি গগুদ্বয়। তাঁর এই চাচাত ভাইকে দেখে তিনি কোলে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। খাদীজার বয়স তখন পনের বছর ।

আবু তালিব খাদীজার নিকট ব্যবসায়ের মূলধন হিসেবে কিছু টাকা চাহিতে মনস্থ করেছিলেন। এই দিকে খাদীজাও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এ সচ্চরিত্রতা ও ব্যবসা ক্ষেতেদ্র অভিজ্ঞতার কথা শুনে আসতেছিলেন । মনে মনে চিন্তা করলেন- হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কেই ব্যবসায়ে নিযুক্ত করা যায় কি না?

একদা খাদীজা একজন রোককে মহানবী (সাঃ)-এর নিকট পাঠায়ে নিজের অভিপ্রায় জ্ঞাপন করলেন।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন- আমি এখন তোমাকে এই বিষয়ে কোন কথা দিতে পারছি না, কারণ আমার চাচাজানের মতামত না জানিয়ে আমি কোন কথা বলতে পারব না- তুমি এখ চলে যাও, আমি পরে আমাদের মতামত জানাচ্ছি।
লোকটি চলে গেল ।

অতঃপর আবু তালিব তাঁর ভগ্নি আতকা বিবিকে পাঠিয়ে দিলেন হযরত খাদীজার নিকট ব্যবসার সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা ও শর্তাদি ঠিক করার জন্য । আতকা ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের কন্যা এবং আবু তালিনের ভগ্নি। খাদীজা (রাঃ) তাঁর পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত এবং যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন ও আদর অভ্যর্থনা করলেন।

হযরত খাদীজার কথাবার্তা ও আদরম অভ্যর্থনায় আতকা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁর নিকট হইতে বিদায় নিলেন।
ওকারা বিন নওফেলের নিকট হতে নিজের স্বপ্নের অর্থ অবগত হওয়ার পর হতে খাদীজা (রাঃ) চিন্তা করছিলেন যে, শেষ পয়গম্বরের আবির্ভাব যদি হইয়েই থাকে এবং তিনি যদি সত্যই মক্কার লোক হন, তবে কে সেই ব্যক্তি?

হাশেমী বংশীয় আবদুল মুত্তালিবের নাতী মুহাম্মদ সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, বিচক্ষণ চরিত্রবান ও আমানতদার ব্যক্তি না কি মক্কার আর একজনও নাই, যদি তাই হয়, তবে সম্ভবতঃ তিনিই হবেন শেষ নবী।
এরপর খাদীজা (রাঃ) আকুল আগ্রহে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। 

তিনি গভীর উৎসাহের সাথে তাঁর বাড়ি-ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত করলেন এবং মহানবী (সাঃ)-এর জন্য নানারূপ সুখাদ্য প্রস্তুত করে রাখলেন।
কি আশ্চর্য ব্যাপার!

একজন কর্ম প্রার্থী আসতেছেন একজন মহাজনের নিকট। সেই প্রার্থীর আগমন উপলক্ষে এত আয়োজন, এত ধুম-ধাম ও এত আকুল আগ্রহ কখনও দেখেছে কি?
আজ যেন বাদীজার বাড়িরতে কোন নবাব বাদশাহর আগমন উপলক্ষে আয়োজন চলছে। দাস-দাসীদের তো একটি মুহূর্ত অবসর নাই- খাদীজারও কাজের অন্ত নাই।

যথা সময়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সাথে নিয়ে আতকা এসে পৌঁছলেন খাদীজার গৃেহ। বাদীজা (রাঃ) তাঁদেরকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং একটি সুকুমল শয্যাবিশিষ্ট পালঙ্কের উপর বসতে দিলেন।

আতকা আজ হযরত খাদীজার বাড়িতে পা দিয়েই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন- আজ খাদীজার বাড়ির এ কি আশ্চর্য পরিবর্তন- একি আশ্চর্য রূপ ধারণ করেছে বাড়িখানা। যে দিকে তাকান তিনি, সেই দিকে নানারূপ নয়ন মনমুগ্ধকর বস্তুসমূহে সুসজ্জিত বাড়িখানা।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মুখের দিকে দৃষ্টি পতিত হওয়া মাত্রই আনন্দে খাজীদার হৃদয় আত্মহারা হয়ে উঠল- তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় খাদীজার মাথা আপনা আনি অবনত হয়ে আসল। তিনি মনের অজান্তে তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করে বসলেন।

এতদিন তিনি তাঁর সম্বন্ধে যে ধারণা পোষণ করে আসতেছিলেন, আজ তাঁকে স্বচোখে দর্শন করে এবং তাঁর সাথে দুই একটা কথাবার্তা বলে তিনি বুঝতে পারলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর নিজের ধারণা হতে বহু উর্দ্ধে।
তিনি বারবার মহানবী (সাঃ)-এর পবিত্র মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন ।

ওরাকা বিন নওফেলের নিকট নিজের স্বপ্নের অর্থ অবগত হওয়ার পর হতে তিনি নিজে তৌরাত ও ইঞ্জিল কেতাব পাঠ করে শেষ নবীর আকৃতি প্রকৃতি, হাব-ভাব, আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা প্রভৃতি সম্বন্ধে যে সকল লক্ষণ অবগত হয়েচিলেন, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে সেগুলো তিনি বিশেষভাবে মিলিয়ে দেখতে লাগলেন। তিনি লক্ষ করলেন- ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত লক্ষণগুলোর প্রত্যেকটিই এ তরুণ যুবকের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে।

তিনি বুঝতে পারলেন- এ মহা পুরুষই তার হৃদয় রাজ্যের সম্রাট হবেন। এ কথা চিন্তা করতেই এক অজানা পুলকে তার সর্বাঙ্গে একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল। তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন।

খাদীজা (রাঃ) তাদেরকে পরম সমাদরে নানা প্রকারের মূল্যবান থানার দ্বারা আপ্যায়িত করলেন। তৎপর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে স্বর্ণময় পালঙ্কে সুকোমল শয্যায় শয়ন করাইয়া দাসীকে আদশে করলেন- পাখার বাতাস করতে। আর তিনি নিজে তাঁর নিকট বসে নানা প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলেন।
খাদীজা (রাঃ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে ধর্ম বিষয়েই আলাপ-আলোচনা করতে আরম্ভ করলেন। 

তিনি এক একটি বিষয়ে প্রশ্ন করলেন আর মহানবী (সাঃ) অত্যন্ত নম্র ও মধুর স্বরে তার উত্তর দেন। বহুক্ষণ উভয়ের মধ্যে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হল । মহানবী (সাঃ)-এর সাথে বিবিধ বিষয়ে আলাপ করে বাদীজা (রাঃ) তার গভীর জ্ঞারেন পরিচয় পেয়ে যেমন বিস্মিতা হলেন, তেমনই আনন্দিত হলেন। 

অতঃপর কাদীজা (রাঃ) মহানবী (সাঃ)-কে বললেন- আপনার প্রয়োজনানুযায়ী অর্থ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারেন। সাধারণতঃ আমি অন্যান্য সকলকে লোক বিশেষ লাভের এক চতুর্থাংশ ও এক তৃতীয়াংশ দিয়ে আসতেছি- আপনাকে আমি লাভের অর্ধে প্রদান করব। 

আপনি যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন মনে করেন আপনাকে আমি তাই দিতে প্রস্তুত আছি, তাতে আমি কোন আগতি न ।
অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর ফুফু আম্মা আতকা অত্যন্ত আনন্দিত হবো গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন।

ব্যবসায়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আশ্রয় দাতা ও লালন-পালনকারী চাচা আবৃ তালিব অভাকান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তার পরিবারের লোকসংখ্যা বেশি ছিল কিন্তু উপার্জনকারী তিনি ছাড়া আর কেহ ছিল না। তাই, তার সংসারে অভাব লেগেই থাকত। সে কারণে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর শিক্ষা-দিক্ষা লাভ করা হল না।

কিন্তু আৰু তালিব ভাতিজাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেয়ার জন্য লক্ষ্য করে নিজেই এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেন; বরং চাচাকে যাতে কিছুটা অর্থোপার্জনে সাহায্য করা যায় তিনি সে দিকেই মনোনিবেশ করলেন।
প্রথম দিকে তিনি চাচার পশুপাল চরিয়ে তাকে কিছুটা সাহায্য করতে লাগলেন। 

তারপর তার সাথে মাঝে মধ্যে ব্যবসায়ী সফরে যাওয়া শুরু করলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আক্ষরিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও জ্ঞান বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় তিনি বাল্যবিধি আরবে যথেষ্ট সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। সুতরাং যে কোন যোগ্যতা এবং কৃতকার্যতা প্রদর্শন করা তাঁর পক্ষে খুবই সহজসাধ্য ছিল। ব্যবসা ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ সততা, সদাচরণ ও কর্ম-দক্ষতা প্রদর্শন করে অচিরেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। 

ব্যবসায়ী মহলে তাঁর পরিচিতি ও সুখ্যাতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিটি লোক তাঁর আচরণ ও কার্য-কলাপে মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রসংশা করতে লাগল।
তিনি যে একজন সৎ, বিশ্বাসী, বিশ্বস্ত এবং অনুপম চরিত্রের লোক, একথা লোকেরা আগে থেকেই জানত। 

কিন্তু ব্যবসা ক্ষেত্রে তিনি ঐ সব গুণ প্রদর্শণ করে সবার নিকট থেকে আরও বেশি প্রসংশা পেলেন। সবার মনে তাঁর প্রতি একটা শ্রদ্ধা এবং ভক্তির উদয় হল। সকলে বলাবলি শুরু করল যে, ব্যবসার ক্ষেত্রে এমন চরিত্রের লোক কেহ কোন দিন দেখে নেই।