হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 14

হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 14

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ

আল্লাহ পাক হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে বহুদিক দিয়েই নারী জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন দান করেছেন। কোন কোন দিক দিয়ে তিনি জগতের নর-নারী উভয় শ্রেণীর মধ্যেই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ইসলাম প্রচার শুরু করার পরে হযরত খাদীজা (রাঃ)-ই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এটা এমন মর্যাদা, যার সাথে অন্য কিছুরই তুলনা হতে পারে না ।

তাঁর ইসলাম গ্রণের পেছনে নিম্নলিখিত কারণগুলো উল্লেখযোগ্য :
১. প্রিয় নবী (সাঃ)-এর প্রথম জীবনের সুনাম সুখ্যাতিতে হযরত খাদীজা (রাঃ) পূর্ব হতেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন।
২. সিরিয়ার বাণিজ্য সফরে সীমাহীন মুনাফা অর্জন ও খাদীজার মাইসারা নাকক ক্রীতদাসের মুখে অনেক অলৌকিক কথা শুনেছিলেন ।
৩. সুদীর্ঘ ১৫ বছর খাদীজা (রাঃ) নবীজীর জীবন সঙ্গীনী থেকে তাঁর বৈশিষ্ট্য ও গুনাবলীর পূর্ণ অভিজ্ঞা অর্জন করেছেন ।

৪. হেরা গুহার সব ঘটনা সবীজী খাদীজাকে জানিয়েছিলেন ।
৫. খাদীজার চাচাতো ভাই ওরাকার স্পষ্ট সাক্ষ্য ও ভবিষ্যদ্বাণী খাদীজা সরাসরি শুনেছিলেন ।
খাদীজা শুনেছিলেন । ৬. আবূ তালিবের সাথে বাণিজ্য সফরে খ্রীষ্টান পাদ্রী বুহাইরার ভবিষ্যদ্বাণীও
৭. নবী করীম (সাঃ)-এর কৈশোর ও বাল্যকালের অলৌকিক কার্যাবলীও খাদীজা অবহিত হয়েছেন ।

আরো অনেক প্রেরণা বা কারণ কারক জরেছে নিম্নে তাঁর সে ইসলাম গ্রহণের আরও একটা ঘটনা উল্লেখ করছি।
কিছুদিন পর্যন্ত ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে ঘন ঘন যাতায়াতের মধ্যে কয়েকদিন পর্যন্ত তার আগমণ বন্ধ ছিল। এ সময় পড়েছিল । হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মন যারপর নাই ব্যগ্র এবং ব্যাকূল ভাবাপন্ন হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ সময় গৃহে গমণ না করে অধিকাংশ সময় হেরা গুহায়ই কাটাতে লাগলেন। 

এমনি অবস্থায় কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর হঠাৎ একদিন জিব্রাঈল (আ) এসে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে গমন করলেন।
এ সময় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জিব্রাঈল (আ) এর গলায় একখানা পাথর ঝুলান দেখলেন। পাথরখানায় লিখা ছিল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ।”

আর একদিন যখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জিব্রাঈল (আ) এর আকৃতি ও কন্ঠস্বর শুনে ভীতি বিহ্বল চিত্তে একখানা চাদরাবৃত অবস্থায় শায়িত ছিলেন ঠিক এমনি অবস্থায় ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) এসে তাঁর উপরে এ আয়াত নাযিল করলেন, 
ইয়া আইয়্যূহাল মুদ্দাচ্ছির! কুম ফাআনথির। ওয়ারাব্বাকা কাকাব্বির ওয়াছিয়াবাকা ফাত্বাহহির। ওয়াররুজয়া ফাইজুর
অর্থাৎ হে চাদরাবৃত ব্যক্তি, উঠ এবং লোকদিগকে আল্লাহর ভয় দেখাও, তোমার প্রভুর মহত্ত্ব বর্ণনা কর, তোমার পোশাক পবিত্র কর, শিরক ও কুফর থেকে দূরে থাক ।

এ নির্দেশের মাধ্যমেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব
ন্যস্ত হয়।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চিরন্তন অভ্যাস ছিল, যখনই তাঁর প্রতি কোন অহি নাযিল হত, সাথে সাথে তিনি তা স্বীয় সহধর্মিণী হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর
কাছে প্রকাশ করতেন।

কাজেই এ অভ্যাস অনুসারে দ্বীন প্রচারের হুকুম আসার সাথে সাথে তিনি সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর নিকটেই প্রকাশ করলেন। তিনি প্রথমে তাঁর নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, খাদীজা! তুমি আমাকে কিরূপ মনে কর?
হযরত খাদীজা (রাঃ) বললেন, আমি আপনাকে একজন অত্যন্ত সত্যবাদী, ন্যায়নিষ্ঠ, সুবিচারক, বিশ্বস্ত, ওয়াদা পালনকারী, আমানতদার এবং সত্যের অনুসারী পুরুষ বলে মনে করি এবং মনে-প্রাণে আপনাকে বিশ্বাস করি।

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর কথা শুনে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, যদি তাই হয়! তবে এ মুহূর্তে পাঠ কর,
"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ" অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ উপাস্য নাই।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর প্রেরিত রাসূল। আর পৌত্তলিকতাকে অসার ও অন্যায় বলে মনে কর এবং কুফর ও শিরককে মনে-প্রাণে ঘৃণা কর ।
বস্তুতঃ হযরত খাদীজা (রাঃ) পৌত্তলিকতাকে কোন দিনই বিশ্বাস করতেন না। 

কুফর ও শিরককেও তিনি কোন দিন প্রশ্রয় দেন নাই এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর যে কোন বাক্য ও কার্যকে তিনি প্রথম থেকে পছন্দ করে আসছিলেন। তাঁর যে কোন উক্তিকে তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন।
তদুপরি তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখে শুনে এবং স্বীয় পিতৃব্য-পুত্র ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের বাক্যসমূহ শুনে তিনি স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট থেকে ঐ ধরনের বক্তব্য শুনার জন্য যেন পূর্ব থেকেই প্রতীক্ষারত অবস্থায় ছিলেন।

সুতরাং স্বামীর উক্তি শুনা মাত্র ভাবনা-চিন্তা না করে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “আমান্না ওয়া সাল্লামনা ইয়া রাসূলাল্লাহ। অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার কথা সম্পূর্ণই বিশ্বাস করলাম এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম।
আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নাই এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।
ইসলামে তখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হয় নাই। উহা ফরজ হয়েছে আরও কিছুদিন পরে।

কিন্তু হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) ও হযরত খাদীজা (রাঃ) তখনও নফল
নামায আদায় করতেন। ইবনে সাদ (রাঃ) বলেন, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং হযরত খাদীজা (রাঃ) দীর্ঘ দিন ধরে গোপনে নামায আদায় করতেন। অতঃপর হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ)-ও তাঁদের সাথে নামায পড়তে শুরু করেন।

হযরত খাদীজা (রাঃ) নিজে ইসলাম গ্রহণ করে এখন কিভাবে এর প্রচার ও প্রসার করা যায়, সে সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চেষ্টার সাথে নিজেকেও মনে-প্রাণে শরীক করে নিলেন
আরবের লোকগণ প্রায় সকলেই মুর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল। সুতরাং ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় ইসলাম প্রচার করা ছিল একটি বিপদজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ।

তাই প্রকাশ্যে মুর্তিপূজার বিরুদ্ধে কোন কিছু বলা এবং খোলাখুলিভাবে নামায আদায় করার পরিবর্তে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর মাত্র দু-তিনজন সঙ্গী নিয়ে গোপনে নামায আদায় করতেন ।
একদিন আফীফা কানছী নামক কোন এক গোত্রের সরদার কিছু মাল-সামান খরিদ করার উদ্দেশে মক্কায় আসলেন।
সেখানে এসে তিনি আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করলেন । তিনি বলেন,
একদিন ভোরবেলা আমি কা'বা গৃহের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। হযরত আব্বাস (রাঃ)-ও আমার নিকটে ছিলেন ।

আমি দেখলাম, জনৈক যুবক কা'বা ঘরের নিকট এসে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন ।
তারপর কা'বার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেলেন। একটু পরেই একটি বালক এসে ঐ যুবকের ডানপার্শ্বে দাঁড়িয়ে গেল ।
তারপর আর একজন স্ত্রীলোক এসে তাঁদের পিছনে দাঁড়িয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর তাঁরা চলে গেলে আমি হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে তাঁদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম।

হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, উহাদের মধ্যকার যুবকটি আমারই ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সাঃ) ইবনে আবদুল্লাহ, বালকটি হল আলী ইবনে আবু তালিব, আর স্ত্রীলোকটি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র-বধু হযরত খাদীজা (রাঃ)।
আফীফ যেন অনেকটা আশ্চার্যের ভাব প্রদর্শন করে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন খাদীজা ? ইনি কি সে ধনবতী মহিলা খাদীজা (রাঃ)? যার ধন-সম্পদের কথা সকলের কাছে প্রচারিত এবং যার ব্যবসা-বাণিজ্য আরবের বিভিন্ন রাজ্যে প্রসারিত।

হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ, সে খাদীজা
আফীফা বললেন, ওখানে এতক্ষণ তাঁরা কি করলেন?
আব্বাস (রাঃ) বললেন, ওখানে তাঁরা নামায পড়ছিল। আমার ভ্রাতুষ্পুত্র বলে যে, তাঁর ধর্ম একমাত্র আল্লাহর ধর্ম। সে যা কিছু করে আল্লাহর নির্দেশানুসারেই করে থাকে। তবে আমি যতদূর জানি, সম্ভবতঃ যমিনের উপর তাঁরা এ তিনজনই মাত্র। 

উহারা ছাড়া আর কেহই তাঁদের পথের অনুসারী হয় নাই।
হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর কথার পরে আফীফ বললেন, মনে হয় কি জানেন? সম্ভবতঃ জগতে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটবে। হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, মোটেও অসম্ভব নয়।
আফীফ বললেন, তাঁদের প্রার্থনার রীতিটি আমার কাছে এতই ভাল লাগছে যে, বলতে কি আমার তাঁদের দলের চতুর্থ ব্যক্তি হয়ে যেতে ইচ্ছা করছে।