হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 18

হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 18

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর ইনতেকাল

উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা (রাঃ) সুদীর্ঘ পচিশ বৎসর কাল হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রিয় সঙ্গিনী, সহধর্মিনী এবং হিতাকাঙ্খীরূপে জীবন অতিবাহিত করে আল্লাহ পাকেরই ইচ্ছানুসারে ইহলোকের মায়া পরিত্যাগ করে পরলোকে যাত্রা করলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুয়তের দশম বৎসরে তাঁর জন্য সর্বাধিক শোকাবহ এ ঘটনাটি সংঘঠিত হয়েছিল।

এই বৎসর হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য আরও একটি মর্মস্তুদ বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটেছিল। তা হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাচা আবু তালিবের মৃত্যু ঘটনা। আবু তালিব ছিলেন হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পতিপালাক, আশ্রয়দাতা, বিপদাপদে উদ্ধারকারী ও শত্রুদের মোকাবেলায় হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য সুদৃঢ় ঢালস্বরূপ।

আবু তালিব যদিও প্রায় আশি বৎসর বয়ঃক্রম কাপ চরম বার্দ্ধক্যে স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ইনতেকাল করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ পাকের অপার মহিমা বোঝা ভার। 

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর এ অসহনীয় শোক-যাতনা দূর না হতেই তাঁর উপর নেমে আসল এ শোক অপেক্ষা ও মারাত্মক শোকাবহ ঘটনা
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রিয়তমা হৃদয়সহচারী, একান্ত সেবিকা, সার্থক অভিভাবিকা, স্বামী' পদে মন-প্রাণ উৎসর্গকারিণী, সঙ্গিনী, সহধর্মিণী হযরত খাদীজা (রাঃ) আবু তালিবের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন পরেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন ।

একেতো বয়ঃপ্রাপ্ত বৃদ্ধা তদুপরি রোগাক্রান্ত দুর্বল দেহে স্বামী সেবায় অক্ষমতা ও অপারগতা হেতু এ সময়ে তিনি কত যে মানসিক অশান্তি ভোগ করেছিলেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না ।
এসময় তিনি শুধু কাঁদতেন আর আল্লাহ পাকের দরবারে এরূপ ফরিয়াদ করতেন, ওহে পরম করুনাময় প্রভু ! তুমি আমাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার স্বামী তোমার প্রিয় নবী (সাঃ)-এর সেবা করার সুযোগ দিলে না ।

হায় প্রভু ! আমি যে কিরূপ হতভাগীনি, আমার মত ভাগ্যহীনা নারী দ্বিতীয়টি কি কেহ দুনিয়ায় আছে?
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর কন্যা ফাতিমা (রাঃ) তখন বয়সে কচি হলেও তাঁর দুঃখিনী মাতার মনের অবস্থা বুঝতে পারতেন।

তাই তিনি সে কচি বয়সেই মনে-প্রাণে পিতার সেবায় নিযুক্ত হয়ে মাতাকে নানাভাবে সান্তনা দিয়ে তার মনের দুঃখ ও বেদনারাশিকে লাঘব করার চেষ্টা
করতেন।

মৃত্যুপথের যাত্রী জননী হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর কচি কন্যাটির এ অপূর্ব প্রয়াস দেখে ভাব-বিহ্বল হয়ে পড়তেন এবং তাঁর ইহ-পরলোকে কল্যাণ কামনা করে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করতেন। এ সময় তাঁর দু'চোখের অশ্রুতে গন্ডদ্বয় ভিজে হয়ে যেত ।
হল ।

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর রোগের অবস্থা দিন দিনই অবনতির দিকে ধাবিত
তিনি তখন নিজের অবস্থা অনুভব করে স্বামী হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট সারা জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অপরাধ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে ক্ষমা প্রদান করে তাঁর জীবনের সৎকার্যাবলি ও তাঁর নিজের এবং ইসলামের প্রতি অতুলনীয় খেদমত এবং সংবাদ শুনিয়ে দিলেন । 

দান-উৎসর্গের কথা উল্লেখ করে সান্ত্বনা দিয়ে পরলোকে তাঁর সৌভাগ্যের শুভ এক সময়ে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ল ।
এ সময় হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার শয্যা পার্শ্বে বসে অত্যন্ত শান্ত মধুর কন্ঠে তাঁকে বললেন, প্রিয়তমা খাদীজা! তোমার কি খুব কষ্ট হয় ?

আল্লাহকে স্মরণ কর, আর তুমি নিশ্চিতরূপে জেনে রাখ, তোমার এ কষ্টের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ পাকের দরবারে তোমার জন্য অফুরন্ত কল্যাণ এবং মঙ্গল রয়েছে।  জেনে রাখ, আখেরাতে তোমার সাক্ষাত এবং স্থান হবে হযরত মরিয়াম, হযরত আছিয়া এবং হযরত হাজেরা ও হযরত সারার সঙ্গে ৷

তুমি আমার পক্ষ থেকে তাঁদের কাছে সালাম পৌছিয়ে দিও।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এরূপ স্নিগ্ধ মধুর সান্তনা বাণী শ্রবণ করতে করতেই তাঁরই একখানা পবিত্র হাতের উপর মস্তক রেখে দুনিয়ার সেরা ভাগ্যবতী মহিলা হযরত খাদীজা (রাঃ) অত্যন্ত শান্তির সাথে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন ।

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর সন্তান-সন্ততি

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হবার পূর্বে হযরত খাদীজা (রাঃ) পর পর তিনটি স্থানে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন । ঐসব স্থানে তাঁর যে সন্তান-সন্ততি হয়েছিল, তাদের সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা
হয়েছে।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গৃহে হযরত খাদীজা (রাঃ) দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর সংসার জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তাঁদের বিয়ের পরে পাঁচ বৎসর পর্যন্ত কোন সন্তানাদি হয় নাই । তারপর তাঁদের সর্বমোট দুজন পুত্র এবং চার জন কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় ।
পুত্রদের নাম ছিল যথাক্রমে কাসেম ও আবদুল্লাহ এবং কন্যাদের নাম ছিল যথাক্রমেঃ জয়নব, রোকাইয়া, উম্মে কুলসুম এবং ফাতেমা জোহরা ।
পুত্রদের মধ্যে আবদুল্লাহ তৈয়্যব ও তাহের এ নাম দু'টিও রাখা হয়েছিল ।

জয়নব ছিলেন সব সন্তানের মধ্যে বয়ঃজ্যেষ্ঠা। পরিণত বয়সে খালাত ভাই আবুল আসের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল ।
রোকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের বিয়ে হয়েছিল তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর সাথে ।
কন্যা । হযরত ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সর্বকনিষ্ঠা গুণে, পুণ্যে ও মর্যাদায় তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে প্রাণাপেক্ষা বেশি ভালবাসতেন ।

তিনি স্বীয় কনিষ্ঠা কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে নিজেই বলেছেন যে, আমার কন্যা ফাতিমা নারী জগতের মাথার মুকুট এবং বেহেশতী নারীদের সরদার হবে । হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং মর্যাদার অভাব নাই ।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে দুনিয়ার সমগ্র নর-নারীদের মধ্যে তিনি সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় ছিলেন ।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীস দিয়েও এটা প্রমাণিত হয়েছে । একদিন কথায় কথায় হযরত আয়েশা (রাঃ) স্বয়ং রাসূল-কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ) -কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, মা ফাতেমা! আমি এ জগতে আপনার একগাছি চুল হয়েও যদি জন্ম লাভ করতাম, তবে আমার জীবন সার্থক হত।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সর্বাধিক প্রিয় পুরুষ ব্যক্তি ও তাঁর স্নেহধন্য শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ)-এর সাথে হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর বিয়ে হয়েছিল ।

মুসলিম জাহানের প্রাতঃস্মরণীয় দু জগদ্বিখ্যাত ইমাম হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হোসাইন (রাঃ)-এর মাধ্যমে নবী (সাঃ)-এর বংশ রক্ষা পেয়েছে।
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর পুত্রদ্বয় কাসেম ও আবদুল্লাহ অতি অল্প বয়সেই ইতেকাল করেছিলেন ।

অন্যান্য ঘটনাবলি

বিবি আয়েশা (রাঃ)-এর আকাঙ্খা
বিবি আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বিবিদের মধ্যে শুধু বিবি খাদীজা (রাঃ) সম্বন্ধেই আমার মতে এরূপ আকাঙ্খা হত যে, হায় আমি যদি তার সমতুল্লা হতে পারতাম।! একমাত্র বিবি খাদীজা (রাঃ) ছাড়া আর কোন বিবি সম্পর্কে আমার এরূপ আকাঙ্খা হয়নি ।

অথচ আমি বিবি খাজিদা (রাঃ)-কে নিজ চোখে দেখিনি। তা সত্ত্বেও আমার হৃদয়ে এরূপ বাসনা হবার কারণ এ যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মুখে বহু সময় বিবি খাদীজা (রাঃ)-এর প্রশংসাবলি শ্রবণ করতাম ।
অনেক সময় এরূপও দেখা গিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর গৃহে বকরী যবেহ করা হলে তিনি তা হতে কিছু মাংস মৃতা বিবি খাদিজা (রাঃ)-এর জীবিত সখী-সহচরীদের গৃহে পাঠায়ে দিতেন ৷

এ ঘটনা হতে ফুটে উঠেছে তা এই যে, যারা বলেন : বিবি খাদীজা (রাঃ) অপেক্ষা বিবি আয়েশার মর্যাদা বেশি, তারা অযৌক্তিক মত পোষণ করছেন
অযৌক্তিক এজন্য বলছি। বিবি আয়েশা (রাঃ)-কে শ্রেষ্ঠা বলা হয় অথচ তাঁর মনেরই আকাঙ্খা ছিল বিবি খাদীজা (রাঃ)-এর মত রমণী হওয়ার। মানুষের স্বভাব ও কামনা তো এটাই থাকে যে, সে উৎকৃষ্টতা ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে, যে অবস্থায় আছে তা অপেক্ষা অবনতি বা নিকৃষ্টতা কখনও কেউই কামনা করে না ।

অতএব আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, বিবি আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণনা দ্বারা অনুমতি হয় যে, বিবি খাদীজা (রাঃ) বিবি আয়েশা (রাঃ) অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন । আর বিবি আয়েশা (রাঃ) তা এ ধরনের আকাঙ্খা দ্বারা নিজের মুখেই স্বীকার করে নিলেন । 

মূলতঃ এ কারণেই বিবি আয়েশা (রাঃ) ঐ রূপ আকাঙ্খা হৃদয়ে পোষণ করেছিলেন।
এ বর্ণনার শেষাংশ দ্বারা এ একটি ব্যাপারে আন্দাজ করা সজহ হয়ে যায়, তা এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তার প্রথমা পত্নী বিবি খাদীজা (রাঃ)-এর কথা তাঁর মৃত্যুর পরেও বিস্তৃত হতে পারে নি।

বরং তাঁর স্মৃতির রেশ যেখনেই ছিল সেখানেই তাঁর আন্তরিক টান ও গভীর অনুরাগ উজ্জিবীত ছিল এবং এ কারণেই দেখা গিয়েছে।
ক কালে যে সব সখী ও সহচরীবৃন্দ বিবি খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যুর পরে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ডেন তাঁদের মাঝেই খাদীজা (রাঃ)-এর স্মৃতির সন্ধান লাভ করেছিলেন।

খাদীজা (রাঃ)-এর প্রিয় সহচরী হিসেবে তাঁদের প্রতি আপনা হতে স্নেহ ও কৃপার ভাব তাঁর হৃদয়ে জেগে উঠেছিল । আর তারই প্রভাবে গৃহে সামান্য ভাল খাদ্য প্রস্তুত করা হলে বা একটি বকরী পর্যন্ত যবেহ করতে তিনি তা হতে কিছু অংশ এদেরকে পাঠায়ে দিতেন। 

বিবি ফাতিমা (রাঃ) আনহাকে সান্ত্বনা দান
বিবি ফাতিমা (রাঃ)-কে মাতা খাদীজা (রাঃ) যে অপরিসীম স্নেহ করতেন তার তুলনা বিরল ।
ঠিক তদ্রূপ ফাতিমা (রাঃ) ও মাতা খাদীজা (রাঃ)-এর জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন ।

বিবি খাদীজা (রাঃ) আনহার মৃত্যুর পরে ফাতিমা (রাঃ)-এর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ল ।
দিনরাত তিনি জননীর শোকে ক্রন্দন করতেন- না হয় শোক ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে বিষণ্ণ বদনে বসে কি যেন চিন্তা করতেন।
হয়ত মাতৃমূর্তিখানি কল্পনায় এঁকে সেই দিকে মাসন-নয়নে তাকিয়ে থাকতেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কলিজার টুকরা ছিলেন ফাতিমা (রাঃ) ।

তাঁর এ অবস্থা দেখে তাঁর হৃদয়-মধ্যে হু হু করে উঠত। কন্যার এ অবসন্ন ভাব ও বিষণ্ন বদন দেখে তিনি সহ্য করতে পারতেন না।
একদা নবীজী (সাঃ) তাঁর প্রিয় কন্যা ফাতিমা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, মা আমার! তোমার বদনখানা এত বিমর্ষ কেন? কিসের ভাবনায় এত পেশোন হয়েছ? ফাতিমা (রাঃ) বললেন, আব্বাজান! আম্মাজানের কথা ভেবে আমার কিছুই ভাল লাগছে না ।

পানাহার করতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। একবার ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ)-কে জিজ্ঞেস করে বলুন, আম্মাজান এখন কি অবস্থায় আছেন ?
উত্তরে নবীজী (সাঃ) বললেন, মা! আমি জিব্রাঈল (আ)-কে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, তোমার মাতা (বেহেশতে) বিবি মরিয়াম ও বিবি আছিয়ার মধ্যস্থলে
অবস্থান করছেন ।