হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 4

হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 4

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর জন্মের পূর্বের ঘটনা

বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায় যে, হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর পিতা-মাতার প্রথমা সন্তান হলেও তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন তাঁর পিতা-মাতার বিয়ের বহুদিন পরে।
তাদের কোন সন্তান ভাগ্যে নেই এ ধরনের একটি হতাশা এবং নৈরাশ্য স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিরাজমান থাকত, কিন্তু অসীম কুদরতের মালিক আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরতের লীলা-খেলা মানুষ কি করে বুঝবে ?

খোয়াইলিদ এবং ফাতিমার হৃদয় যখন নৈরাশ্যের গভীর অন্ধকারে অন্ধকারচ্ছন্ন তখন সহসা আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছায় ফাতিমা অন্তঃস্বত্তা হলেন এবং সে ঘটনায় তার ও তার স্বামীর মনে ক্ষীণ আশার আলোক দেখা দিল, তারা উভয়ে ভাবলেন, এবার হয়ত আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি মুখ তুলে চাইবেন।
ধর্মের-দিক দিয়ে উভয়েই একনিষ্ঠ ছিলেন। এখন থেকে তারা আরও ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হলেন ।

এদিকে ফাতিমার সন্তান-সম্ভবা হবার লক্ষণ দিন দিনই বৃদ্ধি পেতে লাগল । তার গর্ভের বয়স যখন আট মাসে উপনীত হল, তখন একদিন রাতে ফাতিমা একটি অভূতপূর্ব স্বপ্ন দেখলেন যে, ধবধবে শ্বেত বসানাবৃত সৌম্য প্রশান্ত এক দরবেশ শিয়রে বসে তার মাথার উপর হাত রেখে বললেন,
মাগো ! তুমি খুবই ভাগ্যবতী নারী। কারণ অচিরেই তুমি এমন এক সৌভাগ্যবতী কন্যা সন্তান প্রসব করবে যার সমকক্ষ হয়ে এ দুনিয়ায় কোন রমনীই জন্মগ্রহণ করে নেই।

সর্বকালের সর্বশ্রেণীর নারীদের মধ্যে তার আসন উপরে থাকবে। যথাসময়ে সে এক এমন পুরুষের পত্নীত্বের অধিকার লাভে ধন্য হবে, যে মহান পুরুষ মানব কুলের সম্রাট, যার সাথে সৃষ্টিকুলের কারও সাথেই তুলনা হয় না ।
যিনি এ জগতের মানুষের একমাত্র উসিলা। এটুকু বলেই দরবেশ অদৃশ্য হয়ে গেলেন । সাথে সাথে ফাতিমার নিদ্রা ভঙ্গ হয়ে গেল ।

ঘুম থেকে জেগে ফাতিমা মনে মনে এরূপ ধারণা করতে লাগলেন যে, তার মনের মধ্যে যেন কেমন এক পবিত্র আনন্দের ধারা বইছে।
খুব ভোরেই তিনি তার এ অপূর্ব স্বপ্নের বিবরণ স্বামীর নিকট খুলে বললেন।
স্বামী স্বপ্নের বিবরণ শুনে পুলকিত চিত্তে বলে উঠলেন, ফাতিমা! তোমার উপাসনায় খুশি হয়ে হয়ত প্রভু সত্যিই আমাদেরকে একটি ভাগ্যবতী সন্তান দান
করবেন।

কিন্তু ফাতিমা মনে মনে বললেন, যদি স্বপ্নের ফল সত্যিই হয় তাহলে তা তার নিজের কোন যোগ্যতার কারণে নয়, বরং তা অবশ্যই তার পুণ্যবান স্বামীর একনিষ্ঠ উপাসনার কারণে হতে পারে ।

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর শৈশব ও কৈশোর 

৫৫৫ ঈসায়ী সনের কোন এক সকালে আসন্ন সন্তান-সম্ভবা ফাতিমার প্রসব ব্যথা শুরু হয়। খোয়াইলিদের চোখে-মুখে আনন্দ, ঘরে ব্যতিব্যস্ততা ও ব্যগ্রতা প্রকাশ পেতে লাগল। প্রতিবেশীরা বুঝতে পারল যে, ফাতিমার সন্তান প্রসবের সময় উপস্থিত হয়েছে।
বেশি সময় অতিবাহিত হল না। 

ইতোমধ্যে ফাতিমা এক কন্যা সন্তান প্রসব করলেন। ঘরের মধ্যে থেকে একজন মহিলা বের হয়ে খোয়াইলিদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিল ।
সংবাদ শুনা মাত্র তার দু'মাস পূর্বে দেখা ফাতিমার স্বপ্নটির কথা মনে পড়ে গেল ।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে বললেন, ওহে প্রভু! তুমি ফাতিমার স্বপ্নকে সফল করে দাও ।

সদ্য ভূমিষ্ঠা এ কন্যাই সর্বদিক থেকেই যারপর নাই সুদর্শনা, সুলক্ষণা অনুপম ও সুশ্রী ছিল। কন্যাকে দেখে জনক-জননীর চোখ জুড়ে গেল এবং আনন্দে অন্তর শীতল হয়ে গেল ।
পাড়া-প্রতিবেশীগণ দলে দলে ছুটে এসে খোয়াইলিদের এ শিশু কন্যা দেখে বিভিন্নরূপে তার প্রশংসা করতে লাগল এবং জনক-জননীকে ধন্যবাদ জানাতে লাগল । 

খাদীজার দেহের বর্ণ ছিল লাল গোলাপ অথবা দুধে আলাতার সংমিশ্রণ- যাহা আরবের অন্য কোন শিশুর শরীরের বর্ণের সহিত সামঞ্জস্য বিহীন, অধিকন্ত তার শরীর হতে যেন সর্বদাই একটা উজ্জল আভা বিচ্ছুরিত হত । ভূমিষ্ট হওয়ার পর হইতে তার দেহ হতে গোলাপের ন্যায় একটা মৃদু মধুর গন্ধ নির্গত হত ।
যথা সময়ে জনক-জননী তাদের অতি আদরের শিশু কন্যার নাম রাখলেন খাদীজা। 

শিশু খাদীজা তার পিতা ও মাতার একান্ত আদর ও যত্নে লালিত-পালিত হতে লাগলেন এবং একটু একটু করে দিন দিন বড় হতে
লাগলেন । তার মধ্যে কতগুলি বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত হতে লাগল । খাদিজা খুবই কম কাঁদতেন।
তার হাসির মধ্যে অপূর্ব মাধুৰ্য্য ফুটে উঠত। খাওয়ার জন্য অন্যান্য শিশুদের মত মাতাকে বিরক্ত করতেন না। 

পায়খানা-প্রস্রাবের বেগ হওয়া মাত্রই মাতৃকোল থেকে নেমে পড়ার জন্য উদ্বেগ শুরু করতেন ।
এভাবে বিভিন্ন ব্যাপারে তার মধ্যে অ-শিশু সুলভ কিছু কিছু নিদর্শন দেখা যেত । বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আরবের লোকেরা যেমন বাল্যকাল হতেই অত্যন্ত ভালবাসিত ও বিশ্বাস করিত, খাদীজা (রাঃ)-কেও তেমনি মক্কার সর্বস্তরের লোকেই বিশ্বাস করত ও ভালবাসতো ।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে যেমনি বাল্যকালেই মক্কার লোকেরা “আল আমীন” অর্থাৎ, “বিশ্বাসী” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন, খাদীজার চরিত্রে জন্য ঠিক তেমনিই মক্কার লোকেরা তাকে “তাহিরা” অর্থাৎ, “পবিত্রা” উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এমন কি অনেকেই তাকে খাদীজা না বলে “তাহিরা” বলেই ডাকত।
শৈশবকাল পার হয়ে যখন তিনি কৈশোরে পদার্পণ করলেন। তখন তাঁর কার্যকলাপ এবং আচার আচরণের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের চিহ্নসমূহ আরও বেশি প্রকাশ পেতে লাগল ।

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর সমবয়সী বালিকার৷ সকলে মিলে যখন খেলা-ধুলা করত, তখন তিনি তাদের সাথে খেলায় শরীক হতেন না ।
কখনও কখনও তার মাতা নিজে গিয়ে তাঁকে খেলায়রত বালিকাদের মধ্যে দিয়ে আসতেন। 

কিন্তু তাঁর মন তাদের সাথে থাকতে ইচ্ছা করত না।
তাই একদিকে তাঁর মাতা তাঁকে দিয়ে আসতেন খেলার জন্য অন্য দিকে তিনি প্রায় সাথে সাথেই তাঁর মাতার নিকট ছুটে আসতেন।

কন্যার এরূপ স্বভাব-চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করে জননী ফাতিমার মনে জীয় গতকালীন স্বপ্নটির কথা জেগে উঠত যে, এক দরবেশ তাকে স্বপ্নযোগে বলেছিলেন, তোমার গর্ভের কন্যা সন্তানটি জগদ্বরেন্য মহিলারূপে গন্য হবে এবং জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষের সহধর্মিণীর আসন অলঙ্কৃত করবে।
ফাতিমার আর বুঝতে বাকী রইল না যে, সম্ভবতঃ এ জন্যই আল্লাহ পাক তাকে সে অনুযায়ী করে গড়ে তুলছেন।

এমন চিন্তা করতে করতে ফাতিমার মন আনন্দে ভরে উঠত। এদিকে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর বয়স যতই বৃদ্ধি পেতে লাগল, তার সৎগুণাবলী ও স্বভাব-চরিত্র গুলিও তার বয়সের সাথে সাথে উন্নত হতে লাগল, তার উল্লেখিত সৎ স্বভাবগুলির সাথে সংযম, সুরুচি, পবিত্রতা, শালীনতা, নম্রতা, ভদ্রতা ও মায়া-মমতা প্রভৃতি গুণাবলীও যুক্ত হয়েছে।

হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর এ চরিত্র এবং গুণাবলীর খবর প্রথমে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে, পরে দূরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ।
তখন মক্কাবাসীরা তাকে নানাভাবে প্রসংশা করে তাকে ‘তাহেরা' উপাধিতে ভূষিত করল ।